তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রেণু। আমাদের বঙ্গমাতা। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ছিলেন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল। এককথায় অসামান্য একজন মানুষ। মহিয়সী নারী।
খুবই কম বয়সে বাবা-মা হারিয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তারপর চাচাতো ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’
রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে।”
পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারান শেখ ফজিলাতুন্নেছা। দাদা ছাড়া তখন তাঁর কেউ ছিলেন না। দাদাও মারা যান তার দুই বছর পর। তারপর বঙ্গবন্ধুর মায়ের কাছে চলে আসেন রেণু। বঙ্গবন্ধুর ভাইবোনদের সাথেই তিনি বড় হন।
১৯৩৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধুর বয়স ছিল ১৯ বছর। স্ত্রীর বয়স ৯ বছর। আজীবন দুজনের সম্পর্ক ছিল অতিমধুর। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পরও বেগম মুজিব কখনো মুখ ফুটে ‘আহ্!’ শব্দটি করেননি। তাঁদের সংসার আলো করে একে একে জন্ম নেন শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বেশ প্রভাব ছিল। স্বামীর প্রতিটি অর্জনের পেছনে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। মাসের পর মাস কারান্তরীণ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পরিবারের হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করা, তাদের দেখভাল, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযত্ন কোনোটাই কম করেননি।
ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ততার মাঝেও ভুলে যাননি স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। মনটা সব সময়ই তাঁর জন্য কাঁদতো। বঙ্গবন্ধু কারাগারে কেমন আছেন, তিনি সুস্থ আছেন কিনা-এসব খোঁজ-খবর রাখতেন। কারণ স্বামীর জন্য ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা। মায়া। একবার একনাগাড়ে ১৭ থেকে ১৮ মাস কারাগারে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এসময় তাঁর স্বাস্থ্য বেশ খারাপ হয়েছিল। এ অবস্থা দেখে বেগম মুজিব কষ্ট পান। স্বামীকে বলেন, ‘জেলে থাক আপত্তি নেই। তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন… তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?’ শুনে বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, ‘খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি?’
বেগম মুজিব সংসারে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেক কষ্ট করতেন। কিন্তু স্বামীকে কিছুই বলতেন না। নিজে কষ্ট করে স্বামীর জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখতেন। যাতে স্বামীর কষ্ট না হয়। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীই ছিলেন না। ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সুখ-দুঃখের সাথিও।
মুখে কিছু না বললেও বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতেন। আত্মজীবনী লিখেছেন, ‘সে (রেণু) তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণার পেছনেও আছে বেগম মুজিবের সময়োচিত ভূমিকা। রাজনীতির সংকটময় মুহূর্তে সাহস ও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় যোগদানের জন্য রওনা দেওয়ার সময় বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, তাদের নিরাশ করো না। যা বলার চিন্তাভাবনা করেই বলবে।’
এভাবে বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তে কথা দিয়ে, পাশে থেকে বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছেন তিনি। যে কারণে জীবনের কথা লিখতে গিয়ে বারবার রেণুর প্রসঙ্গ টেনেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মতো অসামান্য জীবনকথা লেখার পেছনেও বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল। তিনি জেলগেটে স্বামীকে লেখার জন্য খাতা দিয়ে এসেছিলেন। বারবার অনুরোধের পর শেখ মুজিব আঁকতে শুরু করেছিলেন বর্ণাঢ্য জীবনের চিত্র।
৮ আগস্ট। মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। ১৯৩০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। সেদিন তিনি জন্মেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন অকৃত্রিম বন্ধুর মতো একজন জীবন সঙ্গিনীকে। শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
জন্ম তিথির শুভ দিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি আমাদের বঙ্গমাতাকে। স্মরণ করছি এই দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে তাঁর অবদানকে।
এদেশের দুঃখী মানুষের কী করে ভালো করা যায় সেই চিন্তা করতেন বঙ্গবন্ধু। আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই দায়িত্ব নিয়েছেন। বাবার মতো এ দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি রাজনীতিতে বাবার মতো প্রজ্ঞাবান। ব্যক্তিজীবনে মায়ের মতো ধৈর্য্যশীল, বিনয়ী ও মমতাময়ী। আর তাই জননেত্রী শেখ হাসিনার মুখের দিকে তাকালে আমরা যেমন বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাই, তেমনি খুঁজে পাই ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। জনক হারা এ জাতির তিনিই আপনজন।