সনাতন ধর্মের মানুষদের বর্ষপঞ্জিকা মতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে বৈশাখের প্রথম দিন শতবর্ষী বট গাছের নিচে সিদ্ধেশারী পূজার আয়োজন করা হয়েছে।
দেশসহ পরিবারে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং মঙ্গল কামনায় নারীরা দল বেঁধে পূজাঅর্চনা করে থাকেন। এই পূজাকে কেন্দ্র তিন দিন ব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয়ভাবে এই মেলা বউমেলা নামে পরিচিত। আর এই আনন্দ আয়োজন শুধু একটি সম্প্রদায়কেই নয়, যুক্ত করেছে আশেপাশের সব সম্প্রদায়ের মানুষকে। পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতেও রাখছে ভূমিকা।
স্থানীয়রা জানান, সোনারগাঁ উপজেলার জয়রামপুর গ্রামে এক বটগাছকে সিদ্ধেশ্বরী দেবী রূপে এই পূজার প্রচলন ঘটে প্রায় একশ বছর আগে। পরে বংশ পরম্পরায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই পূজা।
তবে শুরুর দিকে শুধু বাড়ির নববধূদের নিয়ে এই আয়োজন হলেও পরে তাতে বিভিন্ন বয়সের নারীরা অংশ নেন। শতবর্ষী ওই বট গাছটিকে স্থানীয় সনাতন ধর্মের মানুষ সিদ্ধেশ্বরী দেবী বলে আখ্যায়িত করেন।
এ গাছটি সিদ্ধেশ্বরী কালীতলা নামে পরিচিত। কিন্তু এলাকায় এটাকে বলা হয় বউতলা। পুরুষরাও এই মেলায় যান, তবে সংখ্যায় কম।
প্রতি বছরের মতো এবারও সিদ্ধেশ্বরী কালীতলায় সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষ পূজার আয়োজন করেছে। নারীরা মৌসুমী ফল নিয়ে লাইন ধরে বটগাছ বিভিন্ন উপাচার দিয়ে নিবেদন করছেন। পূজা শেষে তা প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হচ্ছে।
মেলায় অংশ নেওয়া পুণ্যার্থীরা জানান, এ মেলায় সাধারণত নববধূ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী নারীরা অংশগ্রহণ করে থাকেন বলে এ মেলার নাম হয়েছে বউ মেলা।
শত বছরের প্রাচীন বটগাছের নিচে এ মেলা বসে। তিন দিনব্যাপী এ মেলার প্রথম দিন গতকাল শনিবার নারীরা বটমূলে পূজা দিয়ে থাকেন।
সংসারের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য নারীরা দলবেঁধে এ মেলায় এসে প্রাচীন বটবৃক্ষকে পূজা দিয়ে থাকেন। পূজায় ফলের ভোগের সঙ্গে মানতের জন্য আনা কবুতর ওড়ানো ও পাঁঠা বলি দেওয়া হয়।
ভোগে দেওয়া বিপুল ফল পূজা-অর্চনা শেষে ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়।
বউ মেলায় পূজা দিতে আসা শিখা দাশ বলেন, আমরা সিদ্ধেশ্বরী কালীদেবী হিসেবে এ বৃক্ষকে পূজা দিয়ে থাকি।
রীতি অনুয়ায়ী এ বৃক্ষের গোড়ায় বিভিন্ন বয়সী নারীরা মাটি, কড়ি ও টাকা দেন। তার ভাষ্যমতে এতে সংসারে শান্তি আসে, মনোবাসনা পূর্ণ হয়। পরিবারের সদস্য যতজন ততবার মাটি দেওয়ার নিয়ম।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকের তালে বৃক্ষতলে পূজায় মগ্ন নারীরা। এছাড়া মেলা প্রাঙ্গণে বাঁশি, কাঠের হাতি, ঘোড়া ও মৃৎশিল্প সামগ্রী, চেয়ার, পিঁড়ি, জলচৌকি ও খই, উড়খা, কদমা, পেঁয়াজু, নিমকি, জিলাপিসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান বসেছে। শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে নাগরদোলার ব্যবস্থা। সবমিলিয়ে জমজমাট বউমেলা।
অনিকা ধর জানান, আমি ছোট বেলা থেকে এখানে পূজা দিয়ে আসছি। আমরা সিদ্ধেশ্বরী কালী দেবী হিসেবে এ গাছে পূজা দিই। প্রথা অনুযায়ী এ গাছের গোড়ায় বিভিন্ন বয়সী নারী মাটি দিয়ে থাকেন। মাটির সঙ্গে একটি করে কড়ি দিতে হয়। এতে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। তাছাড়া পরিবারের সদস্য যত জন, ততবার মাটি দিতে হয়।
পূজার আয়োজক নিলুৎপল রায় বলেন, শুরুর দিকে এখানে পুরুষরা আসতো না, এই পূজা শুধুমাত্র নারীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। জামাইদের নিমন্ত্রণ করা হতো। তারা মেলায় আসতেন, তবে তারা পূজায় অংশ নিতেন না। তাই তখন থেকেই এই মেলা বউ মেলা নামে পরিচিতি পায়।
নববর্ষের প্রথম দিনে দেশবাসীর মঙ্গল কামনায় এই পূজার আয়োজন করা হয়। নতুন বছর যেন ভালো কাটে, সবাই যেন ভালো থাকতে পারি, শান্তিতে থাকতে পারি তাই এই পূজার আয়োজন করা হয়। প্রায় একশ বছর ধরে এই পূজার আয়োজন হচ্ছে।
মেলা প্রাঙ্গণে শিশুদের জন্য নাগরদোলাসহ বেশ কিছু রাইডের ব্যবস্থা করেন আয়োজকরা। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে কেন্দ্র করে সবাই এখানে ছুটে আসেন। বউ মেলাকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকায় তিন দিন ধরে বৈশাখী উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।
জেএন/পিআর