নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বহুল আলোচিত প্রকল্প ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় পড়েছে। সরকার নতুন করে অর্থছাড় না দিলে এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেই হতে পারে এর শেষ ব্যবহার। প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ জানতে এরই মধ্যে সরকারকে চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ইসি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল দেশে ফিরলেই প্রকল্পের সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়ে সরকারকে চিঠি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। ইসির হাতে বর্তমানে অচল ও সচল মিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার মেশিন রয়েছে।
১০ বছর মেয়াদি ক্রয়কৃত দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে ১ লাখ ১০ হাজার নষ্ট হয়ে গেছে, যার দাম প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। বাকি ৪০ হাজারও অকেজো হওয়ার পথে। ইসির সংরক্ষণে থাকা বেশির ভাগ ইভিএম বর্তমানে ব্যবহারের অনুপযোগী।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয় করে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। ওই সময় প্রতিটি মেশিন নির্মাণে খরচ ২ লাখ ৩৫ হাজার ধরে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তখন ইসির পক্ষ থেকে এ মেশিনগুলোকে খুবই উন্নতমানের বলে দাবি করা হয়েছিল। ১০ বছর মেয়াদের এই ইভিএম ৫ বছর না যেতেই অচল হতে শুরু করে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে প্রায় প্রতিটি ইভিএমেই দেখা দেয় কোনো না কোনো সমস্যা। বর্তমানে দেড় লাখের মধ্যে ১ লাখ ৫ হাজার ব্যবহারযোগ্য নয়। এতে রাষ্ট্রের ক্ষতি প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। আর মেরামতের জন্য নেই অর্থেরও জোগান। চলতি বছরের জুনেই শেষ হচ্ছে ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ। এবার সরকারকে চিঠি দিয়ে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ জানতে চাইবে ইসি। চাওয়া হবে বরাদ্দও।
ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান জানিয়েছেন, আগামী কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করবে কিনা, তা জানতে চাওয়া হবে সরকারের কাছে। যদি ব্যবহার করে, তাহলে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি খরচ আছে। সেই পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিলে ফের ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব হবে না।
হাতে থাকা সচল ইভিএম দিয়ে ভোট হবে জুনে শেষ হতে যাওয়া উপজেলা নির্বাচন। সরকার টাকা না দিলে এটিই হবে ইভিএমে শেষ ভোট। নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানিয়েছেন, সরকার থেকে সহায়তা না দিলে ইভিএম প্রকল্প বন্ধ করে দিতে হবে এই জুনে। এর পর আর ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব হবে না।
শুরুতে ইভিএমের মেয়াদ ১০ বছর ধরা হলেও ৫ বছরের মধ্যে অচল বেশির ভাগ মেশিন। প্রকল্পটি বাতিল হলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান সমকালকে বলেন, কিছু কিছু ইভিএমের বাটন নষ্ট, আবার কিছু কিছুর ডিসপ্লে নষ্ট, কিছু ইভিএমের কেবলে সমস্যা। এসব ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করা গেলে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ইভিএমে ফের কাজ করা যাবে। সংসদ, স্থানীয় ও উপনির্বাচন মিলে প্রায় দেড় হাজার নির্বাচন হয়েছে এই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় কেনা প্রতিটি ইভিএম সংরক্ষণে যথাযথ যত্ন নেওয়া সম্ভব হয়নি। এত বিপুল দামে কেনা মেশিনগুলো কোথায় রাখা হবে, তার জন্য প্রকল্পে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে যথাযথ যত্ন ছাড়াই এগুলো স্থান পায় মাঠ কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে। নষ্ট ইভিএমগুলো মেরামতে আগ্রহীও নয় ইসি।
ইসি সূত্রমতে, প্রকল্পের অর্থছাড়ের আগেই ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে উন্নতমানের ইভিএম ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কে এম নূরুল হুদা। প্রাথমিকভাবে ৮০ হাজার ইভিএম কেনে ইসি। ওই সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ইভিএমের বিরোধিতা করলেও কারও পরামর্শই কানে তোলেনি ইসি। বিগত কমিশনের পরিকল্পনা ছিল দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ধাপে ধাপে মোট ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে কেনা হয়। প্রতিটি মেশিনের পেছনে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো, যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের চেয়ে দাম কয়েক গুণ বেশি। তীব্র বিরোধিতার মুখে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এত দামি মেশিন কোথায় রাখা হবে, তার জন্য প্রকল্পে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
ইভিএম মেশিন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করতে হয়। বিদ্যমান স্টোররুমে এ ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ধীরে ধীরে ইভিএমগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার কথা জানিয়েছিল ইসি। এ জন্য নতুন করে গ্রহণ করা হয় ৯ হাজার কোটি টাকার দ্বিতীয় ইভিএম প্রকল্প। কিন্তু সরকারের আর্থিক সংকটের কারণে সেই প্রকল্প স্থগিত করা হয়। আর ইভিএমের পরিবর্তে ব্যালটেই দ্বাদশ সংসদ ভোট হয়। এতে করে বিদ্যমান ইভিএমের প্রতি মনোযোগ হারায় কমিশন।
প্রথম দিকে ইভিএমগুলো আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের বেজমেন্টে রাখা হতো। কিন্তু সমস্যা হয় নির্বাচনের সময় মাঠ পর্যায়ে মেশিন পাঠানো নিয়ে। কেননা, এতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। এর পর সিদ্ধান্ত হয় মাঠ কার্যালয়গুলোতে ইভিএম রাখার। কিন্তু কোনো মাঠ কার্যালয়ে ইভিএম রাখার মতো পর্যাপ্ত কক্ষ নেই। এ ছাড়া ইভিএম রাখার জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন, তাও ছিল না। ২০২২ সালের শেষের দিকে উপজেলা নির্বাচন অফিসে ইভিএম মেশিন উইপোকা, তেলাপোকায় নষ্ট করছে বলে খোদ ইসি কর্মকর্তারাই বৈঠকে জানিয়েছিলেন। ইভিএম উইপোকা, তেলাপোকায় নষ্ট করেছে– এমন অভিযোগে সরেজমিন তদন্ত করে কমিশন। তদন্ত রিপোর্টে ইভিএম সরঞ্জামের জন্য ব্যবহৃত বেশ কিছু কাগজের প্যাকেট এবং আনুষঙ্গিক সামগ্রীর কিছু তার নষ্ট হয়েছে বলে উঠে আসে। এর পর স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার করা ৮৫ হাজার ইভিএম বর্তমানে মাঠ অফিস ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোটকেন্দ্রগুলোতে রাখা হয়। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে। মাঠ কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বারবার তাগাদা দিচ্ছে মেশিনগুলো সরিয়ে নিতে। কিন্তু তাদের এসব মেশিন রাখার জায়গা নেই। এ অবস্থায় প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়, মাঠ কার্যালয়গুলোর পরিধি বাড়ানোর। কিন্তু গণপূর্ত বিভাগ জানিয়েছে আঞ্চলিক, জেলা বা উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়গুলোর যে নকশা, তাতে এগুলো ওপরের দিকে আর বাড়ানো যাবে না। এর পর সিদ্ধান্ত হয় ভবন ভাড়া নেওয়ার। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তেও কোনো কূলকিনারা মিলছে না। কেননা, ইভিএম রাখার জন্য প্রতি উপজেলায় ৫ হাজার বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু এই পরিমাণ জায়গা একই ভবনে মেলে না। আর মিললেও নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো নয় বা ভাড়া পাওয়া যায় না। আর ভাড়া পাওয়া গেলেও দেখা যায় তা বাজেটের চেয়ে বেশি। এসব কারণেই যথাযথ সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি।
জেএন/এমআর