দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব খলিলুর রহমান। পোশাকশিল্প, ইস্পাত, এনার্জি, বিমা সেক্টর, ব্যাংক খাত, টেকনোলজিসহ ১৯টি সেক্টরে বিনিয়োগ রয়েছে শিল্পগ্রুপ কেডিএসের।
৫০ হাজারের অধিক লোকের কর্মসংস্থান করেছে এ শিল্পগ্রুপ। শিল্পোদ্যোক্তা খলিলুর রহমান সম্প্রতি প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
নবনির্বাচিত এ চেয়ারম্যান ব্যাংকটির সোনালি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নানা পরিকল্পনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর কর্মপরিকল্পনার চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
সংবাদমাধ্যম: ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যাংকটি কি এককভাবে ব্যবসা পরিচালনার সক্ষমতা রাখে? ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে চাপ ছিল বলে আলোচনা রয়েছে। এটা কি সঠিক?
খলিলুর রহমান: ব্যাংক একীভূত করার চাপ ছিল এমন দাবির কোনো সত্যতা নেই। আমরা যখন শুনি ব্যাংকটি একীভূত করার কথা চলছে তখন আগের পরিচালনা পর্ষদ সভা করে সিদ্ধান্ত নিই, যে ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে তার চেয়ে আমাদের ব্যাংকের ভিত্তি শক্ত বেশি।
আমরা কেন একীভূত হব? আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পর্ষদ থেকে সিদ্ধান্ত দিলাম, আমরা একীভূত হতে রাজি নই। আমাদের ব্যাংক আমরা চালাব। দরকার হলে নতুন পর্ষদ গঠন করব।
সংবাদমাধ্যম: ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদের অগ্রাধিকার কোনটি?
খলিলুর রহমান: আমি চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক আমার কাছ থেকে লিখিত নিয়েছে। আমি গ্যারান্টার। বাংলাদেশ ব্যাংক যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। ইনশাআল্লাহ আমরা সফল হব। যারা ঋণ নিয়েছে তাদের কাছ থেকে আদায় করবই। করতে হবে, উপায় নেই।
যারা প্রকৃত ব্যবসা করে, দেশে বিনিয়োগ করে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের যথেষ্ট সুযোগ দেব। এটি আমার ব্যাংক কখনো বলি না। আমরা বলি, ন্যাশনাল ব্যাংক জনগণের ব্যাংক, বাংলাদেশের মানুষের ব্যাংক। ১৮ কোটি জনগণের ব্যাংক।
সংবাদমাধ্যম: ব্যাংকটির প্রধান চ্যালেঞ্জ খেলাপি ঋণ কমানো। এক্ষেত্রে ব্যাংকটি কী ধরনের নীতি অনুসরণ করবে? বড় খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের পরিকল্পনা কী?
খলিলুর রহমান: আমরা চেষ্টা করব খেলাপি ঋণ আদায় করতে। প্রকৃত ব্যবসায়ী ঋণ নিলে খেলাপি হতে পারে না। আগে অ্যাসেসমেন্ট করে ঋণ দেওয়া হয়নি। মনিটরিং করা হয়নি। যারা খেলাপি আমরা তাদের প্রত্যেকের কাছে যাব। বড় খেলাপিদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা ভুল স্বীকার করে টাকা পরিশোধে ইচ্ছুক।
আমি আশাবাদী। আমরা ব্যবসা করব। ব্যবসা করে ক্ষতি পুষিয়ে নেব। বড় ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হবে না। যারা ব্যবসায়ী না হয়ে ঋণ নিয়েছে তারাই সমস্যা। অন্তত ৫০ শতাংশ আদায়ে আমরা আশাবাদী। চার বছরে আমরা একটি ভালো অবস্থানে চলে যাব।
সংবাদমাধ্যম: আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আর্থিক প্রতিবেদন সন্তোষজনক হলে একীভূত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে ব্যাংকটি। এজন্য ব্যাংকটি কী ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে?
খলিলুর রহমান: আমরা ব্যবসায়ী, আমরা জানি ব্যাংককে কীভাবে ওপরে তুলতে হয়। ১৯৮৩ সালে আমরা এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছি। ব্যাংকটির বয়স ৪৫ বছর। আমি জানি, ব্যাংকের কোথায় কী আছে। ২০১২ সাল পর্যন্ত এক নম্বর কাতারে ছিল।
ন্যাশনাল ব্যাংক বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক। আমাদের যারা পরিচালক ছিলেন সবাই ব্যবসায়ী ছিলেন। তাদের ব্যবসার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল। আশা করছি দ্রুতই এ ব্যাংক আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।
সংবাদমাধ্যম: নতুন পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকটিতে ৩ হাজার কোটি টাকার আমানত সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে। এ আমানত কার কাছ থেকে কীভাবে সংগ্রহ করা হবে?
খলিলুর রহমান: আগে সাড়ে ৪ টাকা ছিল শেয়ারের দাম। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন ৭ টাকা হয়ে গেছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসছে। ডিপোজিট দিন দিন বাড়ছে। ডিপোজিটের জন্য বন্ধু, ব্যবসায়ীদের কাছে যাব। ডিপোজিট মানে লাভ নয়। ডিপোজিট খাটিয়ে আমানতকারীকে লাভ দিতে হবে। ব্যবসায়ী এবং সাধারণ লোকজন থেকেই আমরা টার্গেট করা আমানত সংগ্রহ করব।
স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, আমরা যখন ৪ কোটি টাকায় এ ব্যাংকের উদ্যোগ নিয়েছিলাম তখন বেসরকারি ব্যাংক ছিল না। আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে, বন্ধুবান্ধব ধরে ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে এনেছি। ব্যাংকের পরিচালক হলে টাকা ফেরত পাবে কি না তখন চিন্তা করত। আমি বলেছি, তুমি টাকা দাও, টাকা ফেরত না পেলে আমি দিয়ে দেব।
এভাবে বন্ধুবান্ধবদের রাজি করিয়েছি। এখনো ওই পলিসি প্রয়োগ করব। বন্ধুদের কাছে যাব। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের আমাদের ব্যাংকে ফিরিয়ে আনব।
সংবাদমাধ্যম: একীভূত হওয়ার কথা শুনে অনেক আমানতকারী আমানত তুলে নিয়েছেন। আমানতকারী গ্রাহকদের আস্থা ফেরানোর জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কোনো অ্যাকশন প্ল্যান আছে কী?
খলিলুর রহমান: আমার দোষ, দুর্বলতা আমি বলতে পারব না। ব্যাংক কার দ্বারা, কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কীভাবে টাকা নিয়েছে সবাই সব জানে। লুটপাটের ধন বাঁচাতে আমরা এখন একত্রিত হয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছি, আমরা একীভূত হব না। আমরা নিজেরা চালাব। আমরা কষ্ট করে চালাব।
সততা থাকলে, কষ্ট করলে এগিয়ে নিতে পারব। যারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন তাদের বোঝাব। যারা ঋণখেলাপি তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করে টাকা ফেরত আনব।
একসময় আমরা অনেক বেশি ডিভিডেন্ট দিয়েছি। ইচ্ছা করলে আমরা উন্নত করে এগিয়ে নিতে পারব। এটি আমার বিশ্বাস। আমরা সফল হবই।
সংবাদমাধ্যম: দেশের ব্যাংকিং অবস্থা কেমন? বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণে করণীয় কী?
খলিলুর রহমান: ব্যাংক ব্যবসা বুঝতে হবে। ব্যাংক ম্যানেজার ব্যবসা বুঝলে ঋণ দিতে পারে। যাকে ঋণ দেবে, তার বিনিয়োগ মনিটরিং করতে হবে। নিয়মিত পরিশোধ করছে কি না দেখতে হবে। বড় লোনে ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বার্ষিক শিডিউল করে মনিটরিং করতে হবে।
যেসব ব্যাংকের স্টাফরা মনিটরিং করেনি সেগুলো কষ্টে পড়ে গেছে। মনিটরিং থাকলে টাকা খেলাপি হয় না। খেলাপির কারণে বিশ্বাস কমে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। প্রকৃত ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা মেরে খাবে না। ব্যবসায়ীদের মুখের কথার দাম আছে। আমরা কোটি কোটি টাকা কথার ওপর দিয়ে থাকি, বেইমানি হয় না।
আমরা চেষ্টা করব বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় আমাদের ১১টি, মালদ্বীপে ৩টি, সিঙ্গাপুরে ২টিসহ বিভিন্ন দেশে শাখা আছে।
এসব শাখার মাধ্যমে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করব। অন্যান্য ব্যাংকগুলোও চেষ্টা করবে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের। সূত্র নিউজটোয়েন্টিফোর