মানুষের দরিদ্রতাকে পুঁজি ও জিম্মি করে কিডনি কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত আন্তঃদেশীয় দালালচক্রের সক্রিয় ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ধানমন্ডি থানা পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের ধানমন্ডি থানা পুলিশের একটি টিম বিশেষ কায়দায় নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কিডনি কেনা-বেচার সাথে জড়িত আন্তঃদেশীয় দালালচক্রের ২ সদস্যকে শনিবার (১১ মে) ধানমন্ডি ২/এ রোডস্থ ইবনেসিনা ডায়াগনোস্টিক সেন্টার এর সামনে থেকে গ্রেফতার করেছে।
পরবর্তীতে আসামীদের দেওয়া তথ্যমতে রবিবার (১২ মে) ভোর সাড়ে ৫ টায় বাগেরহাট থেকে অভিযান পরিচালনা করে অপর একজন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত আসামীরা হলেন- রাজু হাওলাদার (৩২), শাহেদ উদ্দীন (২২) ও আতাহার হোসেন বাপ্পী (২৮)। এই ঘটনায় পলাতক রয়েছে মাছুম (২৭), শাহীন (৩৫), সাগর ওরফে মোস্তফা (৩৭) সহ অজ্ঞাতনামা ১০/১২ জন।
এই দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে কিডনি হারানো ভিকটিম রবিনের মামলার বরাত দিয়ে ডিএমপি জানায়, ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসের মিরপুর-১০ নং শাহ আলী মার্কেটের পিছনে চায়ের দোকানে রবিন তার এক বন্ধুর সাথে চা খাচ্ছিল এবং সংসারের অভাব অনটন নিয়ে কথাবার্তা বলছিল।
ওই কথাবার্তা চলাকালীন পাশে বসা অভিযুক্ত ১নং পলাতক আসামী মাছুমও চা পান করছিল। এসব কথাবার্তা শুনে মাছুম নিজ থেকেই ভিকটিমকে বলে যে, ভারতে তার ব্যবসা আছে এবং ওই প্রতিষ্ঠানে চাকুরি দিতে পারবে।
একপর্যায়ে মোবাইল নম্বর আদান প্রদান হয় এবং পরবর্তীতে ১নং পলাতক আসামীর সাথে প্রায় ১৫/২০ দিন মোবাইলে কথা হয়।
অভিযুক্ত ১নং পলাকত আসামী ভিকটিমকে ভারত নিয়ে যাবে এবং সকল কার্যক্রম করবে মর্মে প্রস্তাব দেন, যাতে ভিকটিম রাজি হয়।
পরবর্তীতে ১নং পলাতক আসামী ভিকটিমকে পাসপোর্ট করে দিতে সহায়তা করে বলে যে, ভারতে তার প্রতিষ্ঠানে চাকুরির জন্য যেতে হলে ডাক্তারি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। সে অনুযায়ী গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে ধানমন্ডি মডেল থানাধীন ৪নং রোডস্থ ল্যাব এইড হাসপাতালে ভিকটিমকে নিয়ে যায় এবং সেখানে অভিযুক্ত গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ রাজু হাওলাদার (৩২) এর সাথে পরিচয় হয়।
অভিযুক্ত আসামী ও ১নং পলাতক আসামীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট সংগ্রহ করে ভারতের ভিসা করানোর জন্য ভিকটিমের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নেয়। ভিসার সব কার্যক্রম শেষ করে অভিযুক্ত ১নং আসামী ও ১নং পলাতক আসামী ভিকটিমের সাথে গ্রেফতারকৃত ২নং আসামী শাহেদ উদ্দিন (২২) এবং ৩নং আসামী মোঃ আতাহার হোসেন বাপ্পী (২৮) দ্বয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে যে, তারা একে অপরের ব্যবসায়িক পার্টনার, বাংলাদেশ ও ভারতে তারা যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে।
আসামীরা অনলাইনে বিমানের টিকেট ক্রয়পূর্বক ভিকটিমের হোয়াটস্ এ্যাপ এ প্রেরণ করে। ওই টিকিট নিয়ে ভিকটিম গত ২২ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ইনডিগো এয়ারলাইনস এর বিমানে করে ভারতের নয়া দিল্লিতে পৌঁছায়।
সেখানে অভিযুক্ত ২নং ও ৩নং পলাতক আসামীরা ভিকটিমের ছবির প্রিন্ট কপি নিয়ে ভিকটিমকে রিসিভ করার জন্য অপেক্ষারত ছিল। ভিকটিমকে রিসিভ করেই অভিযুক্ত ২নং ও ৩নং পলাতক আসামীরা পাসপোর্ট কেড়ে নেয় এবং ভাড়াকৃত একটি প্রাইভেট কারযোগে প্রায় ১ ঘন্টা ২০ মিনিটের দূরত্বে ভারতের ফরিদাবাদ এলাকায় ৫৬৪ নম্বর বাসায় (২ তলা বিশিষ্ট বাসা) নিয়ে যায়।
এভাবে ভারতের ফরিদাবাদ এলাকার ওই ৫৬৪ নম্বর বাসায় ভিকটিমকে ২নং ও ৩নং পলাতক আসামীরা প্রায় ২০/২৫ দিন আটকে রাখে। আটক রাখাকালীন অভিযুক্ত ৩নং আসামী মোঃ মাছুম বাংলাদেশ থেকে সেখানে যায়। মাছুমকে পেয়ে ভিকটিম তার চাকুরির কথা জিজ্ঞাসা করলে সে বিভিন্ন রকম তালবাহানামূলক কথাবার্তা বলে।
অভিযুক্ত ৩নং আসামী ভিকটিমকে তার আর্থিক অনটন, সাংসারিক অর্থনৈতিক দূরবস্থার সুযোগ নিয়ে একটি কিডনি প্রদানের জন্য প্ররোচিত করে এবং ভয়ভীতি দেখায় যে, পাসপোর্ট ছাড়া সে দেশেও ফিরে আসতে পারবে না।
একপর্যায়ে আসামীরা ভিকটিমকে নয়া দিল্লির এশিয়ান হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কিডনি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা করায়। ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে কিছুদিন পর ভারতের গুজরাটে নিয়ে যায় এবং মুক্তিনগর এলাকায় ২ তলা বিশিষ্ট একটি বাসায় রাখে।
রবিনের এজাহার অনুযায়ী, দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে ফুসলিয়ে কাউকে কিছু না বলার শর্তে আসামীরা পরস্পর যোগসাজসে ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে ও সুকৌশলে চলতি বছরের ৪ মার্চ ভারতের গুজরাট কিডনি এন্ড স্পেশালাইজড হাসপাতালে নাভীর নিচে তলপেট বরাবর অপারেশনের মাধ্যমে ১ টি কিডনি প্রদানে বাধ্য করে এবং ফুসলিয়ে কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর নেয়।
অপারেশন শেষে ওই হাসপাতাল থেকে ৪ দিন পরে ছাড়পত্র প্রদান করে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আসামীদের দালাল চক্র ভারতের অজ্ঞাত স্থানে প্রায় ১০/১১ দিন ভিকটিমকে আটক রাখে।
উল্লেখ্য, হাসপাতালে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন মাধ্যমে ভিকটিম জানতে পারে যে, ওই কিডনি আসামীরা দালাল চক্রের কাছে প্রায় ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করে। বিভিন্ন সময়ে ভারতে থাকাকালীন অবস্থায় আসামীরা ভিকটিমকে বলে যে, তাকে ভারতে মেরে ফেললে কী হবে? এমন ভয়ভীতি দেখিয়ে দালালচক্র ভিকটিমকে কিছু টাকা দেওয়ার কথা বলে।
বাংলাদেশে অবস্থানকৃত চক্রের অন্য সদস্যরা ভিকটিমের স্ত্রী ইশরাত জাহানের বিকাশ নম্বর বিভিন্ন সময়ে মোট ৩ লাখ টাকা প্রদান করে এবং পরবর্তীতে আরও ৩ লাখ টাকা দেওয়ার আশ্বাস প্রদান করে।
এভাবে দেশে এসে ভিকটিম বুঝতে পারে যে, সে বড় দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে তার কিডনি হারিয়েছে। কিডনি অপারেশনের ফলে প্রায় ৫ ইঞ্চি পরিমান কাটা দাগ রয়েছে ভিকটিমের শরীরে ।
উল্লেখ্য, ভিকটিম শারীরিকভাবে অসুস্থবোধ করায় গত ১০ মে ধানমন্ডি থানাধীন ল্যাব এইড হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে যাতে লেখা আছে Non Visualized left Kidney। কিডনি হারিয়ে আজ সে এক কর্মক্ষমতাহীন মানুষ।
এমতাবস্থায় এই চক্রের দ্বারা অন্য আরেকজন ব্যক্তি প্রতারিত হতে গেলে ভিকটিম রবিন তা জানতে পারলে ধানমন্ডি থানা পুলিশের সহায়তায় এই ৩ জন আসমীকে গ্রেফতার করে এবং সেই মতো মামলা রুজু হয়। পলাতক আসামীদের দ্রুত গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
জেএন/পিআর