চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে গাড়ি চলাচল শুরু হয়নি। এর মধ্যেই লালখানবাজারে নির্মাণাধীন এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের চারটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে প্রকল্প কর্মকর্তার সঙ্গে কথার বলার পরপরই ফাটলের অংশগুলো সিল করা হয়েছে। ফাটলগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে জিওব্যাগের কাপড়ে। মেরামতের জন্য বানানো হয়েছে লোহার মাচাও। তবে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের দাবি, এগুলো কোনো গভীর ফাটল নয়, হেয়ারলাইন ক্র্যাক। এমন ফাটল যে কোনো নির্মাণাধীন অবকাঠামোতে হওয়া স্বাভাবিক। এতে অবকাঠামোর ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফাটলগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। নকশার ত্রুটি ও স্প্যান বা পিলার দেবে যাওয়ার কারণে এই ফাটল হতে পারে। এটি কতটা ঝুঁকি তৈরি করবে কিংবা এর গভীরতা কতটুকু, তা বের করতে উচ্চতর কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। তবে কাজ শেষ না হওয়ার আগে স্প্যান ও পিলারে এমন ফাটল দেখা দেওয়ায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
৪ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরের লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এলিটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। গত বছরের ১৪ নভেম্বর এক্সপ্রেসওয়েটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের ছয় মাস পার হলেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এখনও গাড়ি চলাচলের উপযোগী করতে পারেনি সিডিএ। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও চীনের প্রতিষ্ঠান র্যা ঙ্কন। এক্সপ্রেসওয়ের মূল অবকাঠামোতে ৩৯৪টি পিলার রয়েছে।
নগরের পতেঙ্গা থেকে আসা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি অংশ ওয়াসা মোড়ে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর আগে লালখানবাজার এলাকায় এক্সপ্রেসওয়ের একটি র্যাম্প সরকারি অফিসার্স কলোনির সামনে নেমেছে। নামার র্যাম্পের অন্তত চারটি পিলার ও স্প্যানে এ ফাটল দেখা দিয়েছে। পিলার নম্বরগুলো হলো– পিআর-১, ২, ৩ ও আপওয়ার্ড পিয়ার বা ইউপিআর-২১।
সরেজমিন দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী প্রধান কার্যালয়ের প্রবেশ মুখ থেকে সরকারি অফিসার্স কলোনি পর্যন্ত ফাটল পিলারের পাশে লোহার মাচা তৈরি করা হয়েছে। চারটি পিলারের প্রতিটিতে নির্দিষ্ট অংশ জিওব্যাগের কাপড় দিয়ে ঢাকা। এর মধ্যে একটি পিলারে ওঠার সিঁড়ি ছিল। তা দিয়ে ওঠে পিলারে ফাটল দেখা যায়। এ ছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অন্য পিলারগুলোতে কোনো ধরনের মাচা দেখা যায়নি।
এক নম্বর পিলারের (পিআর-১) ফাটল দেখা দেওয়া অংশের ছবি তোলা হয়। ছবিগুলো অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একজন শিক্ষক এবং সরকারি দুটি সংস্থায় কর্মরত দুই প্রকৌশলীকে পাঠানো হয়। তারা ছবিগুলো দেখে প্রাথমিকভাবে বলছেন, এগুলো নিশ্চিতভাবে ফাটল। নির্মাণকাজের সময় কোনো ত্রুটির কারণে এই ফাটল তৈরি হতে পারে।
অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ এবং চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জিএম সাদিকুল ইসলাম বলেন, নির্মাণের সময় কোনো ত্রুটির কারণে ফাটল হয়েছে। এটি নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চতর কমিটি গঠন করা দরকার। তার পর জানা যাবে ফাটলের গভীরতা কতটুকু এবং কীভাবে এটি মেরামত করা যাবে।
তবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, এটি হেয়ারলাইন ক্র্যাক (ফাটল)। নির্মাণের সময় কংক্রিটের আধিক্যসহ নানা কারণে নির্মাণাধীন অবকাঠামোতে এ রকম ফাটল হয়ে থাকে। এটা গভীর কোনো ফাটল বা বড় কোনো কিছু নয়। এটি আমরা ঠিক করে ফেলব। এই ফাটলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সক্ষমতায় কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, ঠিকাদারদের কাছ থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন প্রান্ত বুঝে নিচ্ছি। তাতে কোনো ত্রুটি আছে কিনা, তা আমাদের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান খতিয়ে দেখছে। সুতরাং নির্মাণকাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ নেই।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে সরেজমিন দেখা গেছে, দুটি পিলারের (১ নম্বর ও ইউপিআর-২১ নম্বর পিলার) ফাটল সিল করা হয়েছে। মেরামতের জন্য সিলের ওপর পোর্ট বসানো হয়েছে। তা জিওব্যাগের কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ফাটল সিল করার ছবি একজন প্রকৌশলীর কাছে পাঠানো হলে তিনি বলেন, ফাটল মেরামতের জন্য পোর্টগুলো বসানো হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে ইনজেকশন করে এক ধরনের আঠালো পদার্থ ভেতরে প্রবেশ করানো হবে। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ফাটলের আকার নির্ণয় করে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী এটি করা প্রয়োজন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মনির হোসাইন বলেন, এগুলো গভীর কোনো ফাটল নয়। নির্মাণকাজের সময় নানা কারণে এই ধরনের উপরিতলে (সারফেস) ফাটল হয়, এটা স্বাভাবিক। আর এটি অবকাঠামোগত কোনো ফাটল নয়। কাজ শেষ হওয়ার আগে কোথায় কোথায় এই ধরনের ফাটল বা সমস্যা আছে, তা খুঁজে বের করে ঠিক করা হয়। এগুলো নির্মাণকাজেরই অংশ।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ফাটলটির গভীরতা কতটুকু বা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের দাবি অনুযায়ী হেয়ারলাইন ক্র্যাক হলেও সেটি কেন হয়েছে, তা নিয়ে একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে সমকাল। তাতে অন্তত ৯টি কারণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে– ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রস্তুতিতে ভুল থাকা, কাঠামোগত ত্রুটি, সারফেসের বিভিন্ন স্তরের বিচ্ছিন্নতা, তাপমাত্রার পরিবর্তনে ব্যাকগ্রাউন্ডের সরণ, প্লাস্টারের প্রসারণ ও সংকোচন, প্লাস্টারের পুরুত্ব বেশি হলে সংকোচনজনিত কারণে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সিমেন্ট ব্যবহার করা হলে, নির্মাণ শ্রমিকদের ত্রুটিপূর্ণ কাজ এবং সঠিকভাবে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কিউরিং করা না হলে। তবে ফাটল কীভাবে মেরামত করা হবে, তা ফাটলের পরিধি ও ধরনের ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করছেন তারা।
জেএন/এমআর