তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র হননি। তিনি তখন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। একদিন কর্ণফুলী কলেজে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলাম। নগরের চাক্তাই এলাকায় হঠাৎ গাড়ির চাকা ফুটে যায়। গাড়ি সারাবার কাজ চলছিল। আমরা চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছি। মহিউদ্দিন ভাই ছোলাভাজি খুব পছন্দ করতেন। চায়ের দোকানে ছোলাভাজি-চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাঁচ-ছয়টি ছোট ছেলে দোকানে আসে। তাদের সঙ্গে মহিউদ্দিন ভাই মজা করছিলেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা পড়ালেখা কর। তখন কয়েকটি ছেলে জানালো, করি। আবার দুই-একজন বললো, পড়ালেখা ভালো লাগে না। এদের একজনের নাম রুবেল ।
মহিউদ্দিন ভাই রুবেলকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাবা-মা কি করে? রুবেল তার মাকে গিয়ে বলে, ‘মা মহিউদ্দিন নামে একজন নেতা আসছে। তাড়াতাড়ি আস।’ রুবেল দৌড়ে গিয়ে তার মাকে ঘর থেকে নিয়ে আসে।
মহিউদ্দিন ভাই রুবেলের মাকে প্রশ্ন করলেন, আপনার স্বামী কি করেন। উত্তরে তিনি জানালেন, আমার স্বামী কর্ণফুলী পেপার মিলে চাকরি করত। এখন তিনি বেঁচে নেই। তার (স্বামীর) মুখে শুনেছিলাম, তাকে আপনি ঘর থেকে ডেকে নিয়ে চাকরি দিয়েছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জয়নিউজকে এমনটাই জানালেন নগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ফারুখ। তিনি বলেন, অজ পাড়াগাঁর একজন মানুষও মহিউদ্দিন ভাইয়ের সহযোগিতা পেয়েছেন।
চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী শুধু একটি নাম নয়, একটি আদর্শ। তিনি ছিলেন আদর্শবান যোগ্য ও জনপ্রিয় রাজনীতিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। গণমানুষের অতি কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন মেহনতি মানুষের পরম বন্ধু। তাঁর আলোয় আলোকিত হয়েছিল চট্টগ্রামের রাজনীতি। সাধারণ মানুষ ছিল তাঁর পরমাত্মীয়। তাই তিনি জয় করতে পেরেছিলেন তাদের মন।
আজ শনিবার (১৫ ডিসেম্বর) এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তারপরও তিনি জনপ্রিয়। তাঁর জন্য চট্টলার মানুষ আজো নীরবে কাঁদে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এটাই জানালেন।
নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন জয়নিউজকে বলেন, আমরা অনেক সময় বিত্ত-বৈভবের কাছে রাজনীতির পরাজয় দেখি। কিন্তু মহিউদ্দিন ভাই বিত্ত-বৈভবের কাছে কখনো মাথা নোয়াননি। মাথা উঁচু করেই রাজনীতি করে গেছেন। বিত্ত মহিউদ্দিন ভাইয়ের কাছে পরাস্ত হয়েছে। এজন্যই মহিউদ্দিন ভাই আমাদের প্রেরণার উৎস।
কমিউনিস্ট পার্টি চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা জয়নিউজকে বলেন, সাধারণ মানুষের মনের কথা উনি খুব ভালো বুঝতে পারতেন। এজন্যই মানুষের মনে তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন। উনাকে আমরা অনেক সময় মানুষের স্বার্থে, চট্টগ্রামের স্বার্থে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সিদ্ধান্ত নিতে দেখেছি।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলমের মতে, বন্দরনগরীর আপামর ব্যবসায়ী এখনও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে গভীরভাবে অনুভব করেন। এখনও যখন দেখি চট্টগ্রামের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে, চট্টগ্রামকে পিছিয়ে রাখা হচ্ছে কিংবা আমরা ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়েছি, তখনই মহিউদ্দিন ভাইয়ের কথা মনে পড়ে।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার জয়নিউজকে বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী গণমানুষের নেতা ছিলেন। কারণ তিনি রাজনৈতিক চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের পক্ষেই লড়াই করেছেন।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোছলেম উদ্দীন জয়নিউজকে বলেন, চট্টগ্রামের সম্মান-মর্যাদা বৃদ্ধিতে যেসব রাজনীতিক নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, মহিউদ্দিন তাঁদের একজন।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান জয়নিউজকে বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরীর কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। দলের দুঃসময়ে, প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে তাঁর সরব উপস্থিতি নেতাকর্মীদের মাঝে প্রাণসঞ্চার করত। দলের দুর্দিনে তিনি কখনও নির্লিপ্ত থাকেননি। তাঁর সঞ্চয় ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লোভ- লালসার ঊর্ধ্বে থেকে গণমানুষের জন্য কাজ করে গেছেন তিনি।
বর্ণাঢ্য মহিউদ্দিন:
মহিউদ্দিন চৌধুরী স্কুলজীবনে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। সিটি কলেজেই তাঁর বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই সান্নিধ্যে আসেন জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর কাছে গ্রেফতার হন অসংখ্যবার।
১৯৭১-এ সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ছিলেন ভারত-বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশগড়ার সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের আর আদরের ছিলেন মহিউদ্দীন।
বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ভারতে প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দেন। লক্ষ্য সামরিক জান্তা খুনি মোশতাক সরকারকে পরাস্ত করা। জেনারেল জিয়ার হাতে নির্যাতন আর একের পর এক কারাভোগ। এরশাদের শাসনামলে চট্টগ্রামে এরশাদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। ফলে চক্ষুশূল হন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের। আবারও রাজনৈতিক বন্দি। ততদিনে চট্টগ্রামের আমজনতার নয়নমনি হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনে ছিলেন রাজপথে সিপাহসালারের ভূমিকায়। তিনি ‘৯৬ সালে খালেদা জিয়ার প্রহসনের নির্বাচন ও গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
সর্বশেষ নির্যাতিত হন ওয়ান ইলেভেনের সময়। ষাটোধ্র্ব মহিউদ্দিন কারাগারে ছিলেন দীর্ঘ দুই বছর। কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা যান তাঁর আদরের মেয়ে টুম্পা। টুম্পার মৃত্যু অবধারিত জেনেও তাঁকে দেখতে দেয়নি ওয়ান ইলেভেনের সরকার। মানসিক নির্যাতন করেও তাঁকে টলাতে পারেনি ওয়ান ইলেভেন সরকার।
জয়নিউজ/আরসি