বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ২০২৪-২০২৫: আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু পণ্য ও সেবার দামের পরিবর্তন ঘটছে।
সাধারণত অর্থমন্ত্রী যেসব পণ্যের শুল্ক ও কর কমানো বা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন সেসব পণ্যের দাম কমে। আর বিপরীতে যেসব পণ্যে নতুন করে শুল্ক আরোপ বা আগের চেয়ে বাড়ানো হয় সেগুলোর দাম বেড়ে থাকে।
আর বাজেটে থাকা এ ধরনের প্রস্তাবগুলো নিয়মানুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবেই কার্যকর হয়ে যায়।
এবারের বাজেটে যেসব পণ্যের দাম বাড়ছে
মোবাইল কলরেট, সিম ও ইন্টারনেট : বাজেটে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী মোবাইল সিমের দাম বাড়বে। কারণ প্রতিটি সিম কার্ড কিংবা ই-সিমের বিপরীতে মূল্য সংযোজন কর দুশো টাকার পরিবর্তে তিনশ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আবার মোবাইল ফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে যেসব সেবা দেয়া হয় অর্থাৎ কথা বলা কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার -এসব ক্ষেত্রেও মানুষের ব্যয় বাড়বে।
কারণ অর্থমন্ত্রী এ ধরনের সেবার বিপরীতে বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক পনের শতাংশ থেকে বাড়িয়ে বিশ শতাংশে নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন। এর ফলে বেড়ে যাবে টকটাইম ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ।
অর্থাৎ মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখন মানুষকে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। দেশে এখন প্রায় বিশ কোটি মোবাইল ফোন আছে। অনেকে একাধিক ফোন ব্যবহার করে থাকেন।
আমসত্ত্ব ও জুসের দাম বাড়বে : বাংলাদেশে আম থেকে তৈরি হওয়া আমসত্ত্ব বেশ জনপ্রিয়। একই সাথে আম, আনারসের জুসও অনেকের প্রিয়। হালে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পেয়ারা ও তেঁতুলের জুসও।
অর্থমন্ত্রী এবার উৎপাদন পর্যায়ে এসব পণ্যের মূল্য সংযোজন কর পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পনের শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন। ফলে আমসত্ত্বের পাশাপাশি এ চারটি জুসের দাম বেড়ে যাবে বাজারে।
সিগারেট ও বিড়ির দাম বাড়বে : বাজেট আসলে সাধারণত দুয়েকদিন আগে থেকেই আলোচনায় থাকে সিগারেটের দাম। যথারীতি এবারেও তাই হয়েছে। তবে আলোচনা পর্যালোচনার মধ্যেই অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তার বাজেট প্রস্তাবনায় সিগারেট ও বিড়ি পেপারের স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর দ্বিগুণ বাড়িয়েছেন।
আগের সাড়ে সাত শতাংশ হারে করের বিপরীতে তিনি এবার পনের শতাংশ করের প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া বেড়েছে সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক।
অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাবনায় বলেছেন, সিগারেট মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর একটি পণ্য। এ জাতীয় ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার কমানো ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্পূরক শুল্কের হার ৬৫ শতাংশের পরিবর্তে ৬৬ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করছি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গ্রামীণ সমাজে ও স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে বিড়ি জনপ্রিয় আর তুলনামূলক সচ্ছল ব্যক্তিরা সিগারেট বেশি কিনে থাকেন। এর আগে, গত বছরে বিড়ির দাম অপরিবর্তিত রাখা হলেও সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছিলো।
এলইডি ও এনার্জি সেভিংস লাইট : বাংলাদেশে গত প্রায় এক দশক ধরে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হিসেবে এলইডি এবং এনার্জি সেভিংস লাইটের ব্যবহার বাড়ছে।
এবারের বাজেটে ১ থেকে ৫০ ওয়াটের বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্ব এর মূল্য সংযোজন কর পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পনের শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পাশাপাশি ১৮ ও ৩৬ ওয়াটের টিউবলাইট মূল্য সংযোজন করও পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পনের শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আইসক্রিম ও কোমল পানীয় : বাংলাদেশে আইসক্রিম ও কোমল পানীয় ব্যাপক জনপ্রিয়। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে দামি ও ব্র্যান্ডের আইসক্রিম বিক্রির দোকান গত কয়েক বছরে বেশ বেড়েছে। কিন্তু এখন থেকে আইসক্রিম ও কোমল পানীয়র জন্য মানুষকে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে।
কারণ অর্থমন্ত্রী সব ধরনের আইসক্রিমের ওপর বিদ্যমান শুল্ক হার পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দশ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন।
অন্যদিকে কোমল পানীয়র (কার্বনেটেড বেভারেজ) উপর থাকা সম্পূরক শুল্ক হার পঁচিশ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ত্রিশ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন।
একই সাথে বাংলাদেশের মান অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত কার্বনেটেড বেভারেজের জন্য নির্ধারিত মাত্রার উপাদান অপেক্ষা ভিন্নতর মাত্রার উপাদান সম্বলিত পানীয়র ওপর বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ সম্পূরক হার বাড়িয়ে চল্লিশ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন।
ফ্রিজ ও এসি : ফ্রিজ এখন দেশজুড়ে ঘরবাড়িতে নিয়মিত ব্যবহার্য্য পণ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে। পাশাপাশি বাড়ছে এসির ব্যবহারও। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও অনেক বাড়ীতে এখন এসির দেখা মেলে।
তবে এখন ফ্রিজ ও এসি কিনতে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে মানুষকে।
এসি উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে শূন্য শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে সাত শতাংশ এবং রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজের স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে পাঁচ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে সাত শতাংশ মূল্য সংযোজন কর প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাড়ানো হয়েছে ফ্রিজ বা এসির কম্প্রেসরের ওপরেও। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের বাজারে ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর যা বিক্রি হয় তার বেশিরভাগই দেশে উৎপাদিত।
এমিউজমেন্ট ও থিম পার্ক : বাংলাদেশে এখন বিনোদনের জন্য এমিউজমেন্ট ও থিম পার্কগুলো ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। বেড়ানো ছাড়াও পিকনিক বা বড় ধরনের গ্রুপের বিনোদনের জন্য এসব পার্কের সেবা নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। বাজেটে এগুলো ব্যবহারের মূল্য সংযোজন কর দ্বিগুণ করা হয়েছে।
এছাড়াও আরও যেসব পণ্যের দাম এবারের বাজেটে শুল্ক ও কর বৃদ্ধির কারণে বাড়তে পারে তার মধ্যে আছে ইট, সিসি ক্যামেরা, মোটর সাইকেল, লাইট হোল্ডার, ফল, বিদেশী কাজুবাদাম, ম্যাকারেল মাছ, ফুল, এলপিজি সিলিন্ডার, সুইচ, সকেট, আয়রন, জেনারেটর ও ওয়াটার ফিল্টার।
তাছাড়া নতুন বাজেটে কমছে যেসব পণ্যের দাম
নতুন বাজেট অনুযায়ী যেসব পণ্যের দাম কমছে-
কিডনি ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিট : কিডনি ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিট আমদানির জন্য নতুন এইচ কোড তৈরি করে আমদানি শুল্ক ১০% হতে কমিয়ে ১% করা হয়েছে।
স্পাইনাল নিডল : স্পাইনাল নিডলকে সহজলভ্য করতে এটির নতুন এইচ এস কোড তৈরি করে আমদানি শুল্ক ৫% নির্ধারণ করা হয়েছে।
এসেপটিক প্যাক : এসেপটিক প্যাক আমদানিতে আমদানি শুল্ক ২৫% হতে কমিয়ে ১০% নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিদেশি গুঁড়ো দুধ : পুনঃ মোড়কজাতকরণ শিল্পের বিকাশের জন্য গুড়া দুধ আমদানিতে প্রযোজ্য ২০% সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
মিথানল : বাল্ক আকারে মিথানল আমদানির ক্ষেত্রেও আমদানি শুল্ক ১০% হতে কমিয়ে ৫% করা হচ্ছে।
পলিপ্রোপাইলিন ইয়ার্ন : কার্পেট উৎপাদনকারী শিল্পের কাঁচামাল পলিপ্রোপাইলিন ইয়ার্ন আমদানিতে আমদানি শুল্ক ১০% হতে কমিয়ে ৫% নির্ধারণ করা হচ্ছে।
ম্যাংগানিজ : ফেরো এলয় উৎপাদনকারী শিল্পের কাঁচামাল ম্যাংগানিজ আমদানিতে আমদানি শুল্ক ১০% হতে কমিয়ে ৫% ধার্য করা হচ্ছে।
এ ছাড়া চাল, ভোজ্যতেল, চিনি, চকলেট, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেল, ডেঙ্গুর চিকিৎসাসামগ্রী, আমদানিকৃত কিডনি ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিট, ক্যানসার চিকিৎসা সরঞ্জাম, কার্পেট, সুইস-সকেট, ইলেকট্রিক মোটর, লোহা জাতীয় পণ্য (রড, বার ও এঙ্গেল), উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ ও মিথানল দাম কমার তালিকায় রয়েছে।
জেএন/পিআর