বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন সুষম খাদ্যের তীব্র সংকটের মধ্যে বাস করে, যারা দিনে মাত্র এক বা দুই ধরনের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। শৈশব-কালীন খাদ্য সংকট : প্রারম্ভিক শৈশবে পুষ্টি বঞ্চনা—শীর্ষক ইউনিসেফের এক নতুন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য ন্যূনতম যে পাঁচ ধরণের (গ্রুপের) খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি শিশু তা থেকে বঞ্চিত। আর যেসকল শিশুরা নিয়মিত এই পাঁচ ধরনের খাবার খেতে পারে না, তাদের অপুষ্টির একটি মারাত্মক ধরন— শীর্ণকায়ের (উচ্চতার তুলনায় কম ওজন) শিকার হবার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেশি থাকে।
বৃহস্পতিবার (৬ জুন) জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, শৈশব-কালীন পর্যাপ্ত সুষম খাবারের ঘাটতি সব শিশুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে; তবে এর বিশেষ প্রভাব দেখা যায় শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে। কিন্তু বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে দুজনই সুষম খাদ্য সংকটের মধ্যে বসবাস করে। এই অবস্থায় শিশুদের বৈচিত্র্যময় ও পুষ্টিকর খাবার প্রাপ্তির সুযোগ বাড়াতে জরুরি প্রচেষ্টার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী সুষম খাদ্য সংকটের শিকার শিশুদের মোট সংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের (৬৫ শতাংশ) বাস যে ২০টি দেশে, বাংলাদেশ তার একটি। এর পরিণাম সারাজীবনের জন্য স্থায়ী হতে পারে। শৈশবে ভালো পুষ্টি থেকে বঞ্চিত শিশুরা সাধারণত স্কুলে কম ভালো করে, কর্মজীবনে কম উপার্জন করে এবং দারিদ্র্য ও বঞ্চনার চক্রে আটকে থাকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে শৈশব-কালীন সুষম খাদ্যের সংকট বৃদ্ধির পেছনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, পুষ্টিকর খাদ্য কেনায় পরিবারের অক্ষমতা, শিশুকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো সম্পর্কে বাবা-মায়েদের সচেতনতার অভাব, অপুষ্টিকর অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার ও চিনি মিশ্রিত কোমল পানীয়ের ব্যাপক বিপণন ও এসব খাবার খাওয়ার বদভ্যাস এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগের ব্যাপকতা বৃদ্ধি যা খাদ্য ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপর্যয়, বিশেষ করে, সতেজ খাবারের প্রাপ্যতা ও কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয় এবং খাদ্যের দাম রেকর্ড-উচ্চতায় নিয়ে যায়।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের রিপ্রেজেন্টেটিভ শেলডন ইয়েট বলেন, ভালো পুষ্টি শিশুদের বেঁচে থাকা, বৃদ্ধি ও বিকাশের ভিত্তি। শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু তাদের একার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে পরিবারগুলোকে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, যার আওতায় পুষ্টি, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান সেবাগুলোকে আরও উন্নত ও সহজলভ্য করা হবে; সঙ্গে আরও প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বৈচিত্র্যময় ও স্বাস্থ্যকর খাবারগুলোকে সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করার মাধ্যমে দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা সম্ভব; এভাবে প্রতিটি শিশুর জন্য স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর সূচনা নিশ্চিত করা সম্ভব।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শৈশব-কালীন সুষম খাদ্যের সংকট ও অপুষ্টি দূর করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সেবা প্রদানে ইউনিসেফ বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করছে। শিশুদের খাবার ও যত্ন বিষয়ে বাবা-মা ও পরিবারগুলোকে সঠিক পরামর্শ দিতে ইউনিসেফ কমিউনিটি স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মীদেরও (হেলথ ও নিউট্রিশন ওয়ার্কার) সহায়তা করছে। পাশাপাশি, নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা আরও সক্রিয় করতেও ইউনিসেফ কাজ করে চলেছে।
শিশুদের পুষ্টি সুরক্ষায় ইউনিসেফের জরুরি পরামর্শ-
» শিশুর অপুষ্টি প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সেবা প্রদানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে ও আরও উন্নত করতে হবে।
» কমিউনিটির স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মীদের সক্ষমতা তৈরিতে বিনিয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত ও অনুন্নত এলাকায় সুপারিশ অনুযায়ী শিশুদের খাওয়ানো ও যত্নের বিষয়ে বাবা-মা এবং যত্নকারীদের সময়োপযোগী ও ভালো মানের পরামর্শ সহায়তা প্রদান করতে হবে।
» শৈশব-কালীন সুষম খাদ্য সংকটের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা মোকাবিলার প্রচেষ্টা জোরদারের পাশাপাশি খাদ্য, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় যেন নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
» অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার ও কোমল পানীয়ের অনিয়ন্ত্রিত বিপণনসহ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের পরিবেশ থেকে সব শিশুকে রক্ষা করতে।
জেএন/এমআর