চট্টগ্রাম নগরের আতুরার ডিপো। পুরো চট্টগ্রামের গরু-ছাগলের চামড়ার প্রায় ৮০ শতাংশ এখানকার আড়তে সংরক্ষণ করা হয়। চট্টগ্রামে এবার তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের টার্গেট নেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিয়ে রাখেন আড়তদাররা। তবে চামড়ার দাম নিয়ে ব্যবসায়ীরা তুষ্টির কথা জানালেও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন কোরবানিদাতা ও ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, অনেকটা বাধ্য হয়েই আড়তদারদের চাওয়া দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে।
আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঢাকার বাইরে গরুর চামড়ার ন্যূনতম দম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে অনুযায়ী একটি লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ন্যূনতম এক হাজার টাকা। সরকার ঘোষিত দরে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত খরচসহ হিসাব করে দর নির্ধারণ করায় আড়তদাররা আকারভেদে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার চেয়ে বেশি দামে চামড়া কেনায় খরচ করতে পারবেন না।
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্রামাঞ্চল থেকে কমপক্ষে দুই থেকে তিনশ টাকায় চামড়া কেনা হয়। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ কিংবা উত্তর জেলার বিভিন্ন থানা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে নগরের আতুরার ডিপোতে আনতে বড় অঙ্কের পরিবহন ব্যয় হয়। যে কারণে চামড়া কেনামূল্য আড়তদারদের বেঁধে দেওয়া দাম থেকে বেশি হয়। এছাড়া আড়তদাররা যে দামে চামড়া নিচ্ছেন তাতে তারা প্রতিটি চামড়ায় দ্বিগুণ লাভের কৌশল করেছেন।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ এলাকা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে সোমবার বিকেল পাঁচটায় আতুরার ডিপোতে আসেন মৌসুমি ব্যবসায়ী কামাল হোসেন। তিনি বলেন, বিকেলে আতুরার ডিপোতে চামড়া নিয়ে এসে মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। কেউ সাড়ে তিনশ টাকার বেশি দাম দিতে চাইছেন না।
আড়তদাররা এখানে সিন্ডিকেট হয়ে গেছেন। এখানে চামড়া এনে বাধ্য হয়েই আড়তদারদের চাওয়া দামে সাড়ে চারশ চামড়া বিক্রি করেছি। লাভের আশায় এসে প্রায় ৩০ হাজার টাকার মতো লোকসান হলো।
ফটিকছড়ি এলাকা থেকে পিকআপভ্যানে করে চামড়া নিয়ে এসেছেন নাজমুল হক। তিনি বলেন, প্রতি কোরবানিতে চামড়ার ব্যবসা করি। গত কয়েকবছর ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। এবার লবণের দাম কম থাকাতে মনে করেছিলাম চামড়ার ভালো দাম পাওয়া যাবে। কিন্তু আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে চামড়া কিনছেন। খুব পরিচিত না হলে চামড়ার ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করার জন্য দ্রুত লবণ দিতে হয়। লবণ দিতে বেশি দেরি হলে চামড়া পচে যায়। সে কারণে কাঁচা চামড়া এনে রেখে দেওয়া যায় না। দাম কম হোক, কিংবা বেশি হোক আড়তদারদের দিয়ে দিতে হয়। এ সুযোগটা নেয় আড়তদাররা।’
চামড়ার দামের বিষয়ে কথা হলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি মো. আবদুল কাদের সর্দার বলেন, কোরবানির দিন চামড়া সংরক্ষণ করতে গিয়ে বেশি দামে শ্রমিক নিতে হয়। শ্রমিকের মজুরি, লবণের দাম, গুদামের আনুষঙ্গিক ব্যয় মিলে একটি বড় গরুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে প্রায় ৫০০ টাকার মতো খরচ হয়। আবার ন্যূনতম দর নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে তিন-চারশ টাকার বেশি দামে চামড়া কেনা দুঃসাধ্য।
জানা যায়, প্রতিবছরের মতো এবারও কোরবানিতে গরুর চামড়া দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনবে হবে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। গত বছর লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে হিসেবে চট্টগ্রামে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ট্যানারি ব্যবসায়ীদের কিনতে হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। চট্টগ্রামে গত বছর লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা।
পাশাপাশি সারাদেশে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের লবণযুক্ত খাসির চামড়া কিনতে প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা দিতে হবে। গত বছর এসব চামড়ার দাম ছিল ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা। বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা দিতে হবে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের। গত বছর এসব চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা।
অন্যদিকে প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামে এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল ৮ লাখ ৮৫ হাজার। অর্থাৎ চট্টগ্রামে ৮ লাখ ৮৫ হাজার পশু কোরবানি দেওয়া হয়। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির নেতারা বলছেন, গত বছরও চট্টগ্রামে সবমিলিয়ে সাড়ে তিন লাখ লাখ চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এবার সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য রয়েছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যকে বিভ্রান্তিকর বলছেন সমিতির নেতারা।
সহ- সভাপতি মো. আবদুল কাদের সর্দার বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ বিভাগ কোরবানি নিয়ে যে তথ্য দিচ্ছেন সেটি সঠিক নয়। এবার আমরা সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের টার্গেট নিয়েছি। গতবছর আমরা তিন লাখ ১৯ হাজার চামড়া পেয়েছি। কিন্তু প্রাণিসম্পদ বিভাগ বলে আসছে চট্টগ্রামে সাড়ে আট লাখের বেশি কোরবানি হয়। তাহলে বাকি চামড়া যায় কোথায়?
তিনি বলেন, ‘আসলে চট্টগ্রামে কোনো চামড়া পাচার হয় না। প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যটি সঠিক নয়। তারা ডেইরি ফার্ম মালিকদের কাছ থেকে শুনে কোরবানির পশুর তথ্য দেন। মূলত যারা ফার্ম করেন, তারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে সঠিক ব্যবহার করেন না। তাই খামারে কম গরু থাকলেও প্রাণিসম্পদ বিভাগকে বেশি গরু থাকার তথ্য দেন। আর প্রাণিসম্পদ বিভাগের ফার্মগুলোর দেওয়া তথ্য যোগ করে পুরো চট্টগ্রামে কোরবানিযোগ্য পশুর তথ্য দেন। এ তথ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।
এ চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, আমি জেলা প্রশাসনের মিটিংয়েও কোরবানির পশু নিয়ে প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যের বিষয়ে প্রতিবাদ করেছি। সরকার চাইলে প্রত্যেক ইউনিয়ন ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বিষয়টি যাচাই করতে পারে। মানে কোন এলাকায় কয়টি পশু কোরবানি হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করলেই কোরবানির সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চামড়া সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন সংক্রান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় মনিটরিং টিমের দলনেতা বাংলাদেশ চা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মাদ রুহুল আমীন বলেন, ‘এবার চট্টগ্রামে সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে প্রাণিসম্পদ বিভাগ পৌনে ৯ লাখের মতো পশু কোরবানির যে তথ্য দিচ্ছেন, সেটির বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবেন।
তিনি বলেন, এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে, কোরবানির এক সপ্তাহ পড়েই ঢাকায় চামড়া ঢুকতে পারবে। সারাদেশে যাতে যথাসময়ে চামড়া সংরক্ষণ করা হয়, সেই লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চট্টগ্রামেও এবার সুষ্ঠুভাবে চামড়া সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আমরা কোরবানির দিন সকাল থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে পরিদর্শন করেছি। এবার রেকর্ড লবণ উৎপাদন হয়েছে। এতে লবণের দাম বিগত বছরের চেয়ে কম রয়েছে। লবণের সরবরাহও পর্যাপ্ত রয়েছে। যে কারণে চট্টগ্রামের আড়তগুলোতে লবণ নিয়ে আড়তদারদের মধ্যে কোনো টেনশন নেই। এবার টার্গেট অনুযায়ী চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
জেএন/এমআর