চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার নানান উদ্দ্যেগ, অভিযান পরবর্তী হুঁশিয়ারিতেও যেন পাহাড় খেকোদের কোন কর্ণপাতই হয় না।
প্রশাসন ও জরুরি সংস্থাগুলো যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে কয়েকটি স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রভাবশালীদের ইশারায় তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়।
ফলে প্রায় প্রতিবছরই চট্টগ্রামের কোন না কোন পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। ঘটে প্রাণহানির ঘটনাও।
প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা আহ্বান করেন। এর আগে ২৭টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি সভায় সেবা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রতিশ্রুতি দেন।
কিন্তু কার্যত তা বাস্তবায়ন করা হয় না। ফলে দিনের পরদিন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে পাকাপোক্ত হয়ে বাস করেন অবৈধ বাসিন্দারা। তবে ২৮ তম সভায় এসে পাহাড় ব্যবস্থাপনায় গতি ফিরছে,এটা কিছুটা আচ করা যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২০ জুন) বিকেল তিনটার দিকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৮তম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, শুধুমাত্র বর্ষার মৌসুমে নয়, পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদে এখন থেকে বছরজুড়ে কার্যক্রম চলমান থাকবে।
তিনি ঝুকিপূর্ণ বসবাস ঠেকাতে এবং পাহাড় ধসে ক্ষয়ক্ষতি রোধে পাহাড়ে সব অবৈধ পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশনা দেন এবং চট্টগ্রামের সেবা সংস্থার প্রধানদের ১৫ দিন পরপর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটিকে জানাতে নির্দেশনা দেন বিভাগীয় কমিশনার।
বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, পাহাড় কাটলে মামলা হচ্ছে, জরিমানা হচ্ছে। রেগুলার মামলা হচ্ছে আবার ভ্রাম্যমান আদালতেও মামলা হচ্ছে। এমন না যে শুধু আজকের জন্য হচ্ছে। এটা সারাবছর হচ্ছে।
গেল বছরের শেষ দিকে নগরের বায়োজিদ লিংক রোড সংলগ্ন এলাকাসহ ওই সব পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে সতর্কীকরণ সাইন বোর্ড স্থাপন করেন জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
এ বিষয়টি সভায় উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, আমরা ২৬ টি পাহাড়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছি। পাহাড় থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে ১০ একর খাস জমি উদ্ধার করা হয়েছে।
গত এক বছরে শুধু মহানগরে ৫১টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। সেখান থেকে ১১টি পরিবারকে সরিয়ে আনা হয়েছে।
সভায় সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) প্রকৌশলী আব্দুল মান্নান মিয়া জানান, চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৫ হাজার ৩শটি অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। এসব সংযোগ দিয়ে পাহাড়ে ঝুকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। উচ্ছেদের পরেও ফয়েজ লেক এলাকার ১ ও ২ নং ঝিল পাহাড়ে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ রয়ে গেছে।
তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী তওফিকুল আলম দাবি করেন অবৈধ কোনো সংযোগ নেই। তিনি বলেন, অভিযানে আমরা অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আসলে পরে তারা আবারও সংযোগ টেনে নেয়।
সংস্থা দুটির কর্তাদের কথা শোনার পর ঝুঁকিপূর্ণ সকল পাহাড়ে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশনা দেন বিভাগীয় কমিশনার। তাছাড়া ১৫ দিন পর পর এ সংক্রান্ত বিষয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে তথ্য দেওয়ারও নির্দেশ দেন তিনি।
এদিকে পাহাড়ে কোনো অবৈধ গ্যাস আছে কিনা সেটি জানানোর জন্য কর্ণফুলী গ্যাস ডিসট্রিভিউশন লিমিটেডের প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন বিভাগীয় কমিশনার। এ সংক্রান্তে ১৫ দিন পর পর তথ্য দেওয়ার জন্য নির্দেশনাও দেন তিনি।
এ সময় ওয়াসার প্রতিনিধি বলেন, আমরা পাহাড়ে কোনো পানির সংযোগ দেয়নি। যদি কোনো কারণে কোন সংযোগ দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে আমরা সেটি বিচ্ছিন্ন করবো।
উল্লেখ্য : ২০০৭ সালে এক দিনেই পাহাড় ধসে নারী, শিশুসহ মারা যান ১২৭ জন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে মৃত্যু হয় চার পরিবারের ১২ জনের।
২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে মারা যান ১৭ জন। ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুনে মারা যান ২৪ জন। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে মারা যান দুজন।
২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে মারা যান তিনজন, একই বছর ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মা-মেয়ের মৃত্যু হয়।
২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসে প্রাণ হারান ১৫৮ জন। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে মারা যান চারজন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকায় মৃত্যু হয় এক শিশুর। ২০২২ সালের ১৮ জুন মৃত্যু হয় চারজনের।
জেএন/পিআর