সাভারের ১৫৪টি ট্যানারির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে দেশের চামড়া শিল্প খাত। সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর না হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন ঢাকার বাইরের জেলা শহরের চামড়া ব্যবসায়ীরা।
ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, নাটোর, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটসহ দেশের অন্যান্য জেলায় সংগৃহীত লবণযুক্ত চামড়া বেচাকেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আগামী সপ্তাহ নাগাদ জেলা শহরের কাঁচা চামড়া বিক্রির জন্য সাভারের হেমায়েতপুরের শিল্পনগরীতে নিয়ে আসা হবে। এ ছাড়া কয়েকদিনের মধ্যে লবণযুক্ত চামড়া ট্যানারিতে বিক্রির জন্য নিয়ে আসবেন
ঢাকার পোস্তা এবং হাজারীবাগের আড়ত মালিক ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কাক্সিক্ষত দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
তাদের আশঙ্কা, ট্যানারি মালিকরা নানা অজুহাতে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করছে না। এতে চামড়া পাচার হয়ে যেতে পারে ভারত ও চীনে। কারণ এই দুই দেশে কাঁচা চামড়ার ভালো দাম রয়েছে। এই শঙ্কা থেকে সীমান্তে বিজিবি’র কড়া সতর্কতা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, ঢাকা ও আশপাশের কয়েকটি জেলার কাঁচা চামড়া ইতোমধ্যে পোস্তা, হাজারীবাগ এবং সাভারের ট্যানারিতে বেচাকেনা প্রায় শেষ হয়েছে। লবণ ছাড়া চামড়া কিনে তা লবণযুক্ত করা হয়েছে আড়তে। ইতোমধ্যে দশ থেকে ১২ লাখ চামড়া মজুত করেছেন
ঢাকার বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। এখন সারাদেশে সংগৃহীত লবণযুক্ত চামড়া বেচাকেনা শুরু হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি (বিটিএ) শাহিন আহমেদ সম্প্রতি জানিয়েছেন, লবণযুক্ত ভালো চামড়া ট্যানারিতে সরকার নির্ধারিত দামেই বেচাকেনা হবে। এ ব্যাপারে ট্যানারি মালিকদের প্রস্তুতি রয়েছে।
তিনি বলেন, কোরবানির ঈদের দিন দেশের অনেক স্থানে লবণ ছাড়া চামড়া কমদামে বিক্রি হয়েছে ঠিকই কিন্তু যারা লবণযুক্ত চামড়া এখন বিক্রির জন্য নিয়ে আসবেন তারা ভালো দাম পাবেন। তবে পোস্তার ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, ট্যানারি মালিকরা নানা অজুহাতে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করবে না।
জানা গেছে, ট্যানারি ছাড়া এসব চামড়া বিকল্প জায়গায় বিক্রির সুযোগ না থাকায় এ খাতের ব্যবসায়ীরা অনেকটাই জিম্মি। ট্যানারি মালিকরা ক্ষেত্রবিশেষে মনোপলি (একচেটিয়া) ব্যবসার সুযোগ নিয়ে থাকেন।
শুধু পোস্তা বা হাজারীবাগের ব্যবসায়ীরাই নয়, মফস্বলের ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, সাভারে চামড়ার ভালো দাম পাওয়া যাবে না। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, নওগাঁ, নাটোর ও গাইবান্ধার আড়ত মালিকরা জানিয়েছেন, তাদের কাছে লাখ লাখ পিস কোরবানির চামড়া রয়েছে। কিন্তু সাভারের ট্যানারি, পোস্তা কিংবা হাজারীবাগের ব্যবসায়ীরা এখনো যোগাযোগ করেনি। বিপুল পরিমাণ চামড়া নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে পোস্তার একজন ব্যবসায়ী আক্ষেপ করে জনকণ্ঠকে বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে কোটি কোটি টাকা পাওনা রয়েছে আড়ত মালিকদের। এ বছর চামড়া কেনার জন্য কয়েকশ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ পেলেও তারা বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেয়নি। এ অবস্থায় নতুন করে আবার তাদের কাছে চামড়া বিক্রি করতে হবে।
আসলে আমরা আড়তদার ব্যবসায়ীরা ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি। ট্যানারির পাশাপাশি চামড়া বিক্রির বিকল্প উৎস বের করা হলে এ খাতের সমস্যা ও সংকট দূর করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চামড়া খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করে এ শিল্পের রপ্তানি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে চামড়া রপ্তানি ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া এ খাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ শিল্পনগরী করে দেওয়া হয়েছে সাভারে। পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তুলতে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার করে দেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, সাভারের পাশাপাশি রাজশাহী ও চট্টগ্রামে আরও দুটি চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বেশকিছু কাজ করেছে সরকার। কিন্তু ট্যানারি মালিকদের নানা ধরনের কারসাজি ও ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হওয়ার কারণে এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
অভিযোগ রয়েছে-চামড়া কেনার জন্য ব্যাংক ঋণ নেওয়া হয়, কিন্তু সেই টাকা ব্যয় করা হয় অন্য খাতে। এভাবে বছরের পর বছর চামড়া খাতকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অথচ রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের পরই দেশে চামড়া খাতের অবস্থান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চামড়াজাত পণ্যের দাম এত বেড়েছে যে, তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অথচ দেশে কাঁচা চামড়ার দাম বাড়ছে না।
সারা বিশ্বে সব জিনিসের দাম যখন বাড়ছে, তখন বাংলাদেশে শুধু কাঁচা চামড়ার দাম কমছে। এটা অবশ্যই অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চামড়া রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১২৩ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১৪ অর্থবছরে ছিল ৩৯৭ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলার।
স্থানীয় বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদা, আন্তর্জাতিক মানদন্ডে পিছিয়ে থাকা, কাঁচা চামড়া নিয়ে কারসাজিতে বিদেশে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া এবং ক্রেতারা অন্য দেশে চলে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানি কমছে। অথচ চামড়া একসময়ে দেশের তিনটি প্রধান রপ্তানি পণ্যের একটি ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৭ সালে
ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে (এসটিআইই) স্থানান্তর, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মারাত্মক প্রভাবও চামড়া রপ্তানি কমার অন্যতম কারণ। এমন চ্যালেঞ্জের মুখে গত এক দশকে চামড়া রপ্তানি অর্ধেকের বেশি কমেছে বলে জানিয়েছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ২৫ বছর আগেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মোট রপ্তানির ৭৫ শতাংশেরও বেশি অংশ ছিল চামড়ার। কিন্তু তা কমে এখন প্রায় ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে পরিবেশগত মান না মানা, চামড়া রপ্তানি কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ। এসব কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা দাম কম দিয়ে থাকেন।
জানা গেছে, চামড়া কিনতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো থেকে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা সহজ শর্তে বিপুল পরিমাণ ঋণ পেলেও সেই টাকা চামড়ার বাজারে আসছে না। বরং তা চলে যাচ্ছে অন্য ব্যবসায় ও বিনিয়োগে।
এ কারণে অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা কৌশলে কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও পানির দরে চামড়া কিনে নিয়েছেন। বড় গরুর চামড়া কেনা হলেও অপেক্ষাকৃত ছোট গরু ও ছাগলের চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ দেখা যায়নি।
এবার সারাদেশে কোরবানিকৃত প্রায় ৪৮ লাখ ছাগলের চামড়ার সিংহভাগ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যা কেনা হয়েছে তাও পানির দরে। এতে করে ঠকেছেন এতিম, দুস্থ ও অসহায় মানুষ। গরিবের হক মেরে দিয়েছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা।
এ অবস্থায় ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সব ধরনের সংগঠনের পক্ষ থেকে চামড়ার ন্যায্য দাম কার্যকর করার দাবি এসেছে।
এ ছাড়া ব্যাংকগুলো থেকে যে পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে তার পুরোটা দিয়ে যাতে চামড়া কেনা হয় সেদিকে সরকারি নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় চামড়া কেনার অর্থ ব্যবসায়ীরা পাচার কিংবা অন্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার ১ কোটি ৪ লাখ গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। এরমধ্যে গরু কোরবানি বেশি হয়েছে। এর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভেড়া ও মহিষ কোরবানির খবর পাওয়া গেছে। কাক্সিক্ষত হারে চামড়া বেচাকেনা না হওয়ার অন্যতম কারণ অসাধু ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজি। অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা সুকৌশলে এ খাতে অস্থিরতা তৈরি করে নামমাত্র মূল্যে চামড়াগুলো কেনার অপচেষ্টা করছে।
ব্যবসায়ীদের এ কৌশলের কারণে চামড়া অন্য দেশে চলে যেতে পারে এই আশঙ্কা আছে ট্যানারি মালিকদের। এ কারণে চামড়া পাচার ঠেকাতে সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নজরদারি বাড়াতে ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন চামড়া খাত সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীদের আবেদন বিবেচনায় নিয়ে চামড়াবাহী কোনো ট্রাক ঢাকার বাইরে যেতে পারছে না। জেলা শহরের চামড়াবাহী ট্রাক ও লরি শুধু ঢাকায় আসতে পারবে, বর্ডার বা সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গরু ও ছাগলের চামড়ার দাম বেশি। এ ছাড়া চীনে চামড়ার বিপুল চাহিদা রয়েছে।
আগামী সপ্তাহ থেকে জেলা শহরের চামড়া আসবে ঢাকায়। আগামী সপ্তাহ থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরের চামড়া আসবে ঢাকায়।
এ লক্ষ্যে ট্যানারিগুলো ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। চামড়া কিনতে এবারও বিপুল অঙ্কের ঋণ পেয়েছেন পোস্তার আড়তদার ও সাভারের ট্যানারি মালিকরা। সূত্র-জনকন্ঠ