বাজারে ডিমের দাম বাড়ছেই। প্রায় একমাস ধরে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছিল ডিম। গত কয়েকদিনে সেটি খুচরা পর্যায়ে আগের সব রেকর্ড ভেঙে ১৭০ টাকা ডজন বিক্রি হচ্ছে। হালি কিনলে গুনতে হচ্ছে ৬০ টাকা পর্যন্ত। রেকর্ড এ দামের জন্য ডিম ব্যবসায়ী সমিতি ও করপোরেট কোম্পানিগুলোর কারসাজিকে দুষছেন খামারি ও পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন নেতারা। তবে ভিন্ন যুক্তি দিচ্ছে সমিতি।
দুই বছর ধরেই জুলাই-আগস্টে ডিমের দাম অস্বাভাবিক বাড়ছে। দুই বছর আগে (২০২২ সাল) ঠিক এ সময়েই ডিমের ডজন প্রথমবারের মতো ১৫০ টাকা উঠেছিল। গত বছর ছিল ১৫৫ টাকা। এবারও অবশ্য একটু আগেভাগেই ডিমের দামে নতুন রেকর্ড হয়েছে। মে মাসের শেষে ডিমের দাম ছোঁয় ১৬০ টাকা। এর মধ্যে আর খুব কমেনি। বরং আরও বেড়েছে।
প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, ডিমের করপোরেট ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের পুরোনো চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠায় বাজারে এ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) দাবি করেছে, সারাদেশে হঠাৎ করেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিমের বাজার অস্থির হয়ে যায়। এর নেপথ্যে রয়েছে রাজধানীর তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির কারসাজি। কারণ, তারাই সারাদেশের ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
বিপিএ সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ‘ডিম ব্যবসায়ী সমিতি এবং করপোরেট কোম্পানিগুলোর কারসাজিতে হুটহাট বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র খামারিরা যখন ডিম উৎপাদন করেন, তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক চক্র দাম কমিয়ে রাখে। এ অবস্থায় প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদনে টিকে থাকতে পারেন না। তখন ক্ষুদ্র খামারিরা উৎপাদন কমিয়ে দিলে এ অসাধু চক্র ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে নিঃস্ব হচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা।’
ডিম ব্যবসায়ী সমিতি এবং করপোরেট কোম্পানিগুলোর কারসাজিতে হুটহাট বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র খামারিরা যখন ডিম উৎপাদন করেন, তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক চক্র দাম কমিয়ে রাখে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে নিঃস্ব হচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা।- বিপিএ সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার
তার ভাষ্য, করপোরেট কোম্পানি থেকে আড়তে, সেখান থেকে খামারি ও ব্যবসায়ীদের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে এবং ফেসবুকে পোস্ট করে ডিমের বাড়তি বা কম দাম বাস্তবায়ন করে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি। আর সারাদেশেই এ দামে তখন বেচাকেনা চলে। তারা ইচ্ছামতো ডিমের দাম কমিয়ে কোল্ড স্টোরেজে জমা করে এবং পরবর্তীসময়ে সেই ডিমই আবার বাড়তি দামে বাজারে ছাড়া হয়।
রোববার (২৩ জুন) রাজধানীর রামপুরা, মালিবাগ ও কারওয়ান বাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বড় বাজারগুলোতে এখন প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৫৬ টাকায়, যা আবার এসব এলাকার পাড়া-মহল্লার দোকানে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হালি নিলে চাওয়া হচ্ছে ৬০ টাকা।
রামপুরা হাইস্কুল গলিতে রফিক স্টোরে প্রতি ডজন ডিম ১৭০ টাকা দাম চেয়ে বিক্রেতা হাবিব বলেন, ‘ঈদের মধ্যে ডিমের সরবরাহ ছিল না। গতকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে, তবে দাম বেশি। বেশি দামে কেনার কারণে বেশি দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
মালিবাগ বাজারের ডিম বিক্রেতা মাসুদ মিয়া বলেন, ‘প্রায় একমাস ধরে ডিমের বাজার অস্থির হয়ে রয়েছে। ফার্মের মুরগির একটি ডিম পাইকারিতে কিনতে হচ্ছে ১৩ টাকারও বেশি দামে। সামান্য লাভে বিক্রি করলেও প্রতি ডজনের দাম ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে অনেক ডিম ভেঙে যায়। ফলে খুচরায় প্রতি ডজন ১৬৫ টাকার কমে বিক্রি করলে লোকসান হয়।’
বাজারে বাদামি ডিমের চেয়ে সাদা রঙের ডিমের দাম তুলনামূলকভাবে একটু কমই থাকে। তবে এ দফায় দুই পদের ডিমের দামই সমান হয়ে গেছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর এসময় রাজধানী ঢাকার বাজারগুলোতে ডিমের দাম ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা হালি, যা ১২ শতাংশ বেড়েছে।
পাইকারি ডিম বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে ডিমের সরবরাহ কিছুটা কমেছে। এছাড়া এপ্রিল-মে মাসে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারিরা। অতি গরমে অনেকের খামারে মুরগি মারাও গেছে। যার প্রভাব পড়েছে ডিমের বাজারে।
খামারিদের অভিযোগের বিষয়ে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ বলেন, ‘অতিরিক্ত গরমে খামারিদের লাখ লাখ মুরগি মারা গেছে। যে কারণে ডিমের প্রায় ৩০ শতাংশ উৎপাদন কম হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। সরবরাহ কমায় দাম বেড়েছে।’
ডিমের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে হাসিবুল হক নামে একজন খামারি দাবি করেন, ডিম দেওয়া মুরগির বাচ্চা ৯০ থেকে ১১০ টাকা দামে বিক্রি করছে কোম্পানিগুলো, যা গত বছরের চেয়ে চারগুণ। বাচ্চার দামের কারণে ডিমের দাম বেড়েছে। পাশাপাশি পোল্ট্রি ফিডের অস্বাভাবিক দাম আরেকটি কারণ।
আবার কেউ বলছেন, সরবরাহ কমার সুযোগে অনেকে কমিশন বাড়িয়ে নিচ্ছেন। কোম্পানিগুলোও চড়া দামে ডিম বিক্রি করছে। বাংলাদেশ এগ প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, সরবরাহ কমার পাশাপাশি চাহিদাও একটু বেড়েছে। আর পাইকাররা কমিশন বাড়িয়ে রাখায় ডিমের দাম বেশি পড়ছে।
দেশের মানুষ অনেক দিন ধরেই প্রতি পিস ডিম ১০ টাকায় কিনে অভ্যস্ত ছিল। তবে গত তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে ডিমের দাম। এ ভোগ্যপণ্যটির বাজার হয়ে উঠেছে অস্থির। দেশে এর আগে কখনো এত দামে মানুষকে ডিম কিনতে হয়নি বলে জানিয়েছেন খামারি ও ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, ২০০৯ ও ২০১০ সালে ডিমের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল। কারণ ছিল বার্ড ফ্লু। তখন এ রোগের কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যায়। তাতে বড় ধরনের সরবরাহ সংকট তৈরি হয়। কিন্তু তখনো দাম এতটা বাড়েনি। এরপর গত দুই বছর ডিমের দাম যখন রেকর্ড স্পর্শ করে, তখন অবশ্য বাজারে পোল্ট্রি খাদ্যের দামও বেশি ছিল।
এখন খাদ্যের দাম কিছুটা কমলেও ডিমের দাম কমেনি। বরং ব্যবসায়ীদের একটি অংশ পোল্ট্রি খাদ্যের চড়া দামকেই বাজারে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। তবে ডিম কিংবা মুরগির দাম বারবার ওঠানামার কারণ হিসেবে অনেকে বাজার সিন্ডিকেট ও করপোরেট ব্যবসায়ীদের দায়ী করেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ১০ অর্থবছরে ডিম ও দুধ উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এসময়ে মাংস উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি, যা এখন বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ কোটি। তবে বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে উৎপাদন বাড়ার সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ভোক্তারা।
হুটহাট দাম বাড়ার জন্য বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকির অভাব, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট এবং সরবরাহে অব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ বারবারই ঘুরেফিরে সামনে আসছে। এ নিয়ে ভোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও খামারিরা সরকারের যথাযথ হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে করেন।
এ বিষয়ে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘যেখানে সব পণ্যের দাম বেশি সেখানে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তদের ভরসা থাকে ডিমে। সেটাও ১৬০ টাকায় ডজন কিনতে হচ্ছে। তাতে বোঝা যায় সাধারণ মানুষ কীভাবে তাদের সংসার চালাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি পণ্যে অসাধু ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক মুনাফা করার প্রবণতা থামাতে হবে। সরকারকে আন্তরিকতার সঙ্গে এসব বিষয় দেখা দরকার। বাজার তদারকি বাড়ানো দরকার।’
জেএন/এমআর