বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের খবরে যখন সারাদেশে তোলপাড় চলছে, তখন দুদক থেকে পাওয়া যাচ্ছে পিলে চমকানো তথ্য। চট্টগ্রামেও দুদকের জালে রয়েছেন অন্তত ৩০ পুলিশ সদস্য এবং তাদের বেশ কয়েকজনের স্ত্রীও। যাদের মধ্যে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার পাশাপাশি আছেন থানার ওসিসহ একাধিক উপ পরিদর্শক (এসআই)। এমন ৩০ জনের তথ্য এসেছে। যাদের কেউ কেউ এখনও কর্মরত রয়েছেন চট্টগ্রামে। আবার বেশিরভাগ বদলি হয়ে চাকরি করছেন অন্য জেলায়। দুদক অনুসন্ধানে নেমে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বেশির ভাগেরই গাড়ি, বাড়ি, মার্কেট, জাহাজ, ব্যাংক ব্যালান্সসহ বিপুল বিত্তবৈভবের হদিস পেয়েছে।
খবর নিয়ে জানা গেছে, আলোচ্য এসব পুলিশ কর্মকর্তাদের ডজন খানেকের বিরুদ্ধে মামলা আছে দুদকে। যাদের কারও কারও অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ ইতিমধ্যে জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও পুলিশের এসব সদস্যের স্ত্রীদের বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে সংস্থাটিতে। বাকি যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান, প্রাথমিকভাবে তাদের অনেকের ‘সম্পদের পাহাড়’র খোঁজ পেয়েছে দুদক। এদের বিরুদ্ধেও শীঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। আলোচ্য এসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দুদক চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-১ ও ২ এবং কক্সবাজার জেলা কার্যালয় এবং দুদকের প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তারা অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
দুদক সূত্র জানান, আলোচ্য পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজনের অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে। তাদের অবৈধ আয় ও সম্পদের খোঁজও পেয়েছে দুদক। আরো কয়েকজনকে স্ত্রীসহ নিজের সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
তাদের একজন চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) কামরুল হাসান। পুলিশের ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা এবং তার স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে ঢাকা-চট্টগ্রামের বহু সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। পাঁচ জাহাজ থেকে শুরু করে রয়েছে শতাধিক ফ্ল্যাট ও দোকান। এছাড়া বহু জমির খোঁজ পায় দুদক। বাস্তবে তাদের সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাকরিরত অবস্থায় ঘুষ গ্রহণ, চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার কামরুল হাসান বলেন, আমি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না, আজও নেই। আমি বৈধভাবেই চট্টগ্রাম ও সাভারে সম্পদের মালিক হয়েছি। সব আয়কর নথিতে রয়েছে।
ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে দুদক অনুসন্ধানে নেমে সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরের সবচেয়ে অভিজাত খুলশী আবাসিক এলাকায় ‘ফয়জুন ভিস্তা’ অ্যাপার্টমেন্টের অষ্টম তলায় সি-৭ নামে ২ হাজার ৫৭০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ও ১৩৬ বর্গফুটের পাড়ি পার্কিং থাকার তথ্য পায়। সোয়া সাত লাখ টাকায় ফ্ল্যাট ও মাত্র ২৫ হাজার টাকায় পার্কিং স্পেস কিনেছেন– আয়কর নথিতে দাবি করলেও খুলশীতে আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য তিন কোটি টাকার বেশি। পাশাপাশি নগরের পশ্চিম নাসিরাবাদ মৌজায় সাত শতক ভূমির ওপর চতুর্থ তলাবিশিষ্ট বাড়ি রয়েছে।
জমিসহ ভবন নির্মাণে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা খরচ দেখালেও নাসিরাবাদ এলাকায় এক শতক ভূমিই এক কোটি টাকার বেশি মূল্যে কেনাবেচা হচ্ছে। সেই হিসাবে ভূমি ও ভবনের বাজারমূল্য সাত-আট কোটি টাকা। একইভাবে ঢাকার সাভারে ১০৭ শতক জায়গার ওপর সাভার সিটি সেন্টার নামে ১২ তলা ভবনের চারজন অংশীদারের একজন এডিসি কামরুল। সেখানে তিনি কাগজ-কলমে সাত কোটি ৫২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এ ভবনের বেজমেন্টে ৯০টি দোকান, প্রথম তলায় ১৪০টি দোকান, দ্বিতীয় তলায় ১৪৬টি দোকান, তৃতীয় তলায় ৮৯টি দোকান, চতুর্থ তলায় ১০৩টি দোকান ও ৫ হাজার বর্গফুটের ফুডকোর্ট, পঞ্চম তলায় অফিস ও ষষ্ঠ তলায় ৬৭টি ফ্ল্যাট রয়েছে। বাজারমূল্যে এ সম্পদের মূল্য শতকোটি টাকার বেশি। ঢাকার সাভারে মার্কেট ছাড়াও সাভার সিটি টাওয়ার নামে একটি ১০ তলা আবাসিক ভবনেরও অংশীদার। সেখানে ৫৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এভাবেই চট্টগ্রাম ও ঢাকায় সম্পদ আর সম্পদ গড়ে তুলেছেন তিনি। এ ছাড়া কামরুল চট্টগ্রাম নগরের উত্তর হালিশহর, নাসিরাবাদ, চান্দগাঁও এলাকা এবং ঢাকার সাভারে ১৫৪ শতক জমি ও দুটি বাড়ি কিনেছেন। ব্যাংকে ১ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার বন্ড ও এফডিআর রয়েছে।
তাঁর স্ত্রী সায়মার নামে রয়েছে পাঁচটি জাহাজ। চট্টগ্রামের হালিশহরে ৪০ শতক নাল জমি রয়েছে। তা মাত্র ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায় ক্রয় দেখানো হলেও বর্তমান বাজারে সেই জমির মূল্য ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে তাঁর নামে ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও দেড় কোটি টাকায় কেনা পাঁচটি জাহাজ রয়েছে।
১৯৮৯ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে যোগ দেন কামরুল হাসান। পরে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর বিএনপি জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন থানায় ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০২৩ সালের ৩১ মে দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে তাঁর সম্পদের অনুসন্ধানের অনুমোদন দেওয়া হয়।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা ছাড়াও দুদক সূত্রে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডে অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ‘চাঁদাবাজি’র মাধ্যমে ‘অবৈধভাবে’ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বাঁশখালী থানার ওসি (সাবেক সীতাকুণ্ড থানার ওসি) তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে দুদক। গেল মাসে আলোচিত এ ওসিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়। এছাড়াও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও ভোগদখলে থাকায় সম্পদ বিবরণী দাখিলের সুপারিশ করে দুদক প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) কামরুল হাসান ও তার স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে।
সিএমপির এডিসি (ক্রাইম) কামরুল হাসান ও বাঁশখালীর ওসি তোফায়েল আহমেদ ছাড়াও আনোয়ারা সার্কেলের সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার মো. মফিজ উদ্দিন, বন্দর থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক এস এম ময়নুল ইসলাম, ডিবি পুলিশের ওসি মো. আব্দুর রহমান, বন্দর থানার সাবেক ওসি মঈনুল হোসেন, কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি ও বর্তমানে চান্দগাঁও থানার ওসি জাহিদুল কবির, চান্দগাঁও থানার সাবেক ওসি খাইরুল ইসলাম ও পাহাড়তলী জোনের সহকারী কমিশনার ময়নুর রহমান (চাদগাঁও থানার সাবেক ওসি) চান্দগাঁও থানার সাবেক ওসি তদন্ত মো. মনিবুর রহমান, বাকলিয়া থানার এসআই রবিউল হোসেন, মোশাররফ, কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি জসিম উদ্দিন ও একই থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ মহসীনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে দুদক। এছাড়াও পাহাড়তলী থানার সাবেক ওসি রঞ্জিত কুমার বড়ুয়া, সন্দ্বীপ থানার সাবেক ওসি মুহাম্মদ সামছুল ইসলাম, বোয়ালখালী থানার সাবেক ওসি মো. সাইরুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক রাজু আহমেদ, কর্ণফুলী ও নগরীর আকবরশাহ থানার সাবেক ওসি মুহাম্মদ আলমগীর, সাবেক ওসি আনোয়ার হোসেন, আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পটিয়া থানার সাবেক ওসি মো. রেফায়েত উল্যাহ চৌধুরী, লোহাগাড়া থানার সাবেক ওসি মো. শাহজাহান, ট্রাফিক সার্জেন্ট মোহাম্মদ শেখ রাসেল, ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পুলিশের সহকারী পরিচালক (এএসপি) মো. আবুল হাশেম, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মীর নজরুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক মো. শাহ আলম, সাবেক ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক আবুল কাশেম চৌধুরী, সহকারী পুলিশ কমিশনার এ বি এম সাহাদাৎ হোসেন মজুমদার, রাঙ্গুনিয়া থানার উপ-পরিদর্শক সুমন কুমার দে রয়েছে এ তালিকায়। এদের মধ্যে মীর নজরুল ইসলাম, শাহ আলম, আবুল কাশেম চৌধুরী, এ বি এম সাহাদাৎ হোসেন মজুমদার, সুমন কুমার দে, আবুল হাশেম, প্রদীপ কুমার দাশ, রেফায়েত উল্যাহ চৌধুরী, মো. শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সংস্থাটি।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এ ১৫ জন পুলিশ কর্মকর্তার অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে। জানতে চাইলে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপ-পরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত জানান, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তারা ছাড়াও বেশ কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান। তবে তিনি বিস্তাতির জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এ কার্যালয় ছাড়াও চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-২ এ চলছে ১১ জন পুলিশ কর্মকর্তার অনুসন্ধান-তদন্ত। তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-পরিচালক মো. আতিকুল আলম অনুসন্ধান ও তদন্ত চলমান থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বাকিদের বিষয়ে কক্সবাজার জেলা কার্যালয় ও ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে অনুসন্ধান ও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি অবগত নই।’
অন্যদিকে, সিএমপির জনসংযোগ কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. তারেক আজিজ বলেন, ‘কোন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলে দুদক তাদের মতো করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
জেএন/এমআর