পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী ও দুই কন্যার স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টিম। প্রাথমিকভাবে এসব সম্পদের কোনো উৎস পায়নি তারা।
অবৈধ এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকায় কয়েকটি ফ্ল্যাট এবং বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখা বিপুল পরিমাণ অর্থ। অনুসন্ধানের স্বার্থে এখনই এসব সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করতে চাচ্ছে না দুদক। বেনজীর পরিবারের স্থাবর ও অস্থাবর এসব সম্পদের দালিলিক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে তারা।
অনুসন্ধান টিম প্রাথািমকভাবে বেনজীর আহমেদের নামে নয় কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৫৬৫ টাকা, তার স্ত্রী জীসান মীর্জার নামে ২১ কেটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৩ টাকা, জ্যেষ্ঠ কন্যা ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীরের নামে আট কোটি ১০ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯৬ টাকা এবং মেজো কন্যা তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে মোট চার কোটি ৭৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৮ টাকা থাকার কথা জানতে পেরেছে। আপাতত এ তথ্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য যথেষ্ট।
প্রাথমিক এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের বিবরণ চেয়ে ইতোমধ্যে আলাদা নোটিশ দিয়েছে দুদক।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) সম্পদের নোটিশ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন বলেন, বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানকারী টিম প্রাথমিক অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে। এজন্য তাদের নামে দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬(২) ধারা মোতাবেক আলাদা আলাদা সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক প্রমাণ ছাড়াও অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে দেশে-বিদেশে আরও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। এর পক্ষে প্রমাণ ও দলিল সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে।
দুদক থেকে পাঠানো সম্পদের নোটিশে বলা হয়েছে, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে দুদকের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, আপনারা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ/সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। নিজে ও আপনাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তির নামে-বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, দায়-দেনা, আয়ের উৎস ও তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণী কমিশনে দাখিল করবেন। এ আদেশ পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে নির্ধারিত ছকে সম্পদ বিবরণী দাখিলে ব্যর্থ হলে কিংবা মিথ্যা সম্পদ বিবরণী দাখিল করলে দুদক আইন, ২০০৪ এর ৫(২) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকৃতপক্ষে আদালতের নির্দেশনায় বেনজীর আহমেদের প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক বা ফ্রিজ করা হয়েছে। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল, সম্পত্তি যেন কোনোক্রমেই বেহাত না হয়ে যায় কিংবা পাচার না হয়ে যায় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া। বর্তমানে সম্পদগুলো একটি একটি করে যাচাই করে দেখা হচ্ছে। অনেক সম্পদ তার আয়কর নথিতে দেখানো আছে। আপাতত ওই সম্পদগুলো আমলে নিয়ে অবৈধ সম্পদের হিসাব করা হচ্ছে। কারণ দুদকের মামলায় দালিলিক প্রমাণ দরকার হয়।
তিনি বলেন, হাজার কোটি টাকার সম্পদ মনে হলেও মামলাযোগ্য হিসেবে অফিসিয়াল দলিলকেই আমলে নিতে হবে। সেই হিসেবে এখন পর্যন্ত সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদকে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বলে প্রমাণ পেয়েছে দুদক টিম। এটিকে ভিত্তি ধরে অনুসন্ধান এগোচ্ছে। ভবিষ্যতে অবৈধ সম্পদের পরিমাণ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এ বছরের ৩১ মার্চ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদিনের চেরাগ’ এবং ৩ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে একটি দৈনিক পত্রিকায় পরপর ২ দিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের নানা অভিযোগ উঠে আসে। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
গত ২২ এপ্রিল বেনজীর, তার স্ত্রী জিসান মির্জা, দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দদিক। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান শুরু করে।
অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বেনজীর আহমেদকে ৬ জুন এবং স্ত্রী জীসান মীর্জা ও দুই মেয়েকে ৯ জুন প্রথম দফায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে দুদক। তবে তারা ওই তারিখে হাজির না হয়ে সময় চান।
এরপর দ্বিতীয় দফায় ২৩ ও ২৪ জুন তলব করা হয়। তখনও তারা হাজির না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে অভিযোগের বিপরীতে লিখিত বক্তব্য জমা দেন।
এর মধ্যে গত ২৩ ও ২৬ মে দুদকের দুই দফায় করা আবেদনের প্রেক্ষিতে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ঢাকার ফ্ল্যাট ও কোম্পানির শেয়ার জব্দের (ক্রোক) নির্দেশ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। ২৩ মে তাদের ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি এবং ৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়।
এরপর ২৬ মে তাদের আরও ১১৯টি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন আদালত। এগুলোর মধ্যে রাজধানীর গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, সাভারে একটি জমি ছাড়াও মাদারীপুরে ১১৪টি দলিলের সম্পত্তি রয়েছে। দুই দফা মিলিয়ে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের ৬২১ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
আদেশ অনুযায়ী তাদের ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সিকিউরিটিজের (শেয়ার) টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া, পুঁজিবাজারের ইলেকট্রনিক্স শেয়ার সংরক্ষণাগার সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা সব বিও হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) ফ্রিজ করে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর বাইরে অন্যান্য সম্পদ জব্দের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জব্দকৃত সম্পত্তি দেখভালে ইতোমধ্যে রিসিভার নিয়োগ করা হয়েছে।
বেনজীর পরিবারের জমি বিক্রি ও হস্তান্তর বন্ধে আদালতের আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রার ও সংশ্লিষ্ট সাব রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠানো হয়েছে। এসব জমি অন্য কারো নামে যাতে নামজারি না করা হয়, সেজন্য আদালতের রায়ের কপি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট এসিল্যান্ড অফিসে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া, কোম্পানির মালিকানা হস্তান্তর বন্ধে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসগুলোর পরিদপ্তরে আদালতের ওই আদেশ পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকে জমা থাকা টাকা উত্তোলন বন্ধে অবরুদ্ধের আদেশ সোনালী ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতির আরও একটি অভিযোগ দুদকে চলমান রয়েছে। গত ২৫ জুন এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই করতে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের দুই অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও দুই পরিচালকসহ ১৫ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পাসপোর্টে তার পুলিশ পরিচয় আড়াল করেছেন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তিনি সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে নীল রঙের অফিশিয়াল পাসপোর্ট করেননি। সুযোগ থাকার পরও নেননি লাল পাসপোর্ট। এমনকি বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে সাধারণ পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রেও আশ্রয় নিয়েছেন জালিয়াতির।
জেএন/এমআর