বোটানিক্যাল গার্ডেন,মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। শিক্ষা গবেষণা ও উদ্ভিদ সংরক্ষণে কাজ করাই যার উদ্দেশ্য। কিন্তু সম্প্রতি অসাধু কিছু ব্যক্তির যোগসাজশে এ উদ্যানে শিক্ষা গবেষণা দূরে থাক, এটি রীতিমতো পরিণত হয়েছে অশ্লীলতা আর মাদকের ভূস্বর্গে।
উদ্যানের ভেতরে সাইনবোর্ডে ধুমপান/অশ্লীলতা পরিহার করার কথা বলা হলেও ভেতরে সবই চলে। চোখ থাকতেও যেন অন্ধ কর্তৃপক্ষ,অভিযোগ সাধারণ মানুষের। অনেকে বলেছেন, উদ্যান জুড়ে দায়সারা সচেতনতামূলক প্রচারণা ছাড়া কর্তৃপক্ষ নিরব।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বোটানিক্যাল গার্ডেনের গহিন অংশে ছেলেমেয়েদের বিশেষ মুহূর্তে কাটানোর ব্যবস্থা করে অর্থ আদায় করা হয়। এ ছাড়া উদ্যানে কাজ করা কর্মীরা নারীসঙ্গী সাপ্লাইও দিয়ে থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উদ্যানে কাজ করা স্থানীয় এক নারী বলেন, ‘সারা দিন পোলা-মাইয়ারা আসে। বাজে কাম করে ট্যাহা দিয়া। ভিতরের ব্যাডারা এই ট্যাহা নেয়। কেউ ফডু তুলতে গেলে মাইরও খায়। এর লাইগ্যা কেউ কথা কয় না।’
তাছাড়া উদ্যানের ভেতরে রয়েছে বহু দোকানপাট। যেখানে খাবারের পাশাপাশি রয়েছে ধূমপানের ব্যবস্থা। যদিও কাগুজে নিয়ম অনুযায়ী উদ্যানে ধূমপান এমনকি আগুন সম্পর্কিত কিছুই ব্যবহার করবার সুযোগ নেই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পরে উদ্যানে প্রবেশের অনুমতি না থাকলেও সবই চলছে এখানে। কেউ এ নিয়ে কথা বলতে গেলে উল্টো আনসার দিয়ে ভয় দেখানোরও চেষ্টা করা হয়।
অন্যদিকে উদ্যানের ভেতরে বেশ কিছু পকেটগেট রয়েছে, যা দিয়ে মাদক সেবন ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটে।
জানা গেছে, উদ্যানের ভেতরে প্রতি দুজন ছেলেমেয়েকে বিশেষ ব্যবস্থায় সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দিতে জায়গাভেদে নেওয়া হয় ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। যেখানে সাধারণভাবে ভেতরে প্রবেশ করতে লাগত ২০ টাকা।
অন্যদিকে শরীরচর্চায় উদ্যানে যেতে ছিল না কোনো ধরাবাঁধা সময়। বছরপ্রতি করতে হতো ১ হাজার টাকার কার্ড। তবে সব নিয়ম পাল্টে গেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে।
নতুন বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ১২ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সীদের ১০০ টাকার বিনিময়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এবং ১২ বছরের কমবয়সীদের জন্য ৫০ টাকা দিয়ে উদ্যানে থাকতে পারবেন।
এ ছাড়া শরীরচর্চার জন্য বার্ষিক ৫০০ টাকার বিনিময়ে কার্ড করতে হবে। তবে থাকা যাবে শুধু সকাল ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত।
সূত্রমতে, প্রতি বছর টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারাদার নির্বাচন করা হয়। যাদের কাছে নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে হস্তান্তর করা হয় টিকিট বিক্রির প্রক্রিয়া।
পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বারবার মেসার্স সাগর এন্টারপ্রাইজ নামের একই প্রতিষ্ঠান ইজারা পেয়ে থাকে এ টিকিট বিক্রির। ২০২৪ সালের ইজারা পেতে দিতে হয়েছে ৩ কোটি টাকারও বেশি।
প্রশ্ন উঠেছে, প্রতিদিন কী পরিমাণ দর্শনার্থী আসেন উদ্যানে? এ দর্শনার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া টাকায় কর্মীদের কীভাবে বেতন পরিশোধ করা হয় এ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে? যদিও কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত কোনো ডেটা দেখাতে পারেনি।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি ইজারাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স সাগর এন্টারপ্রাইজের কাউকে।
মিরপুরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘শরীরচর্চা করতে আমাদের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে সারা দিন অশালীন কর্মকাণ্ডকে প্রমোট করে সেখান থেকে বাড়তি আয় করে সংশ্লিষ্টরা।
তাই শরীরচর্চাকারীদের ফ্রেমে আটকে রাখতে চাচ্ছে তারা। এ ছাড়া সাধারণ মানুষ এত টাকা দিয়ে ভেতরে যাবে না। যারা অসামাজিক কাজ করতে আসে, তারা ১০০ টাকা নয়, এর বাইরেও টাকা দিয়ে যাবে।’
মিরপুর-১-এ থাকা আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘বার্ষিক কার্ড করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা দিতে পারেনি। উল্টো বলল ৫০০ টাকার কার্ড নিতে, যা দিয়ে সকাল ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত থাকা যাবে উদ্যানে। অথচ আমি আমার সন্তানকে স্কুলে দিয়ে ৮টায় ব্যায়াম করতে যেতাম। কিন্তু এখন তা সম্ভব হচ্ছে না।
এ ছাড়া বিকেলে যারা ব্যায়াম করেন তারা কোনো কার্ড পাচ্ছেন না। উল্টো কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিদিন ১০০ টাকা দিয়ে ব্যায়াম করতে হবে।’
উদ্যানে প্রবেশ মূল্য বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন। তারা বলছে, ঢাকায় দিন দিন সবুজের পরিমাণ কমছে। শিশুরা সবুজ দেখতে পায় না। তার মধ্যে এত ফি বাড়ানো শিশুদের বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করবে। তাই এটির প্রত্যাহার প্রয়োজন।
উদ্যানের এমন পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় উদ্ভিদ উদ্যান পরিচালক শওকত ইমরান আরাফাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। সবকিছুতেই পরিবর্তন আসবে। শুধু একটু সময় প্রয়োজন।
অশ্লীলতা বন্ধ করতে দ্রুতই উদ্যানে সিসি ক্যামেরা লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমরা চিহ্নিত করা শুরু করেছি কারা এগুলোর সঙ্গে যুক্ত। যারাই যুক্ত হবে তাদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে আনসার কমান্ডারকে বদলি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘বড় পরিবর্তন আসবে এ উদ্যানে। তাছাড়া টিকিটের মূল্য কমাতে আমি মন্ত্রণালয়ে পুনর্বিবেচনার জন্য প্রস্তাবও করেছি।
উদ্ভিদ উদ্যানের মূল ফটকেও আসবে পরিবর্তন। এ ছাড়া ভেতরে যুক্ত হবে ম্যানগ্রোভ কর্নার ও মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যোদ্ধাদের স্মৃতি স্মরণে প্রাকৃতিক স্থাপনা। সূত্র : দেশ রূপান্তর