মোস্ট ওয়ান্টেড! ইংরেজি এই দুই শব্দের সঠিক বাংলা খুঁজে পাওয়া না গেলেও দুনিয়াজুড়েই বহুল পরিচিত। পালিয়ে বেড়ানো দুর্ধর্ষ সব অপরাধীদের জন্যই তৈরি হয় মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকা।
এই তালিকায় যাদের নাম থাকে তাদের খোঁজ চায় পুলিশ। কেউ খোঁজ দিতে পারলে থাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কারও। নিষ্ঠুর খুনি কিংবা সিরিয়াল কিলার থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ সব অপরাধীরই ঠাঁই হয় এই মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায়।
কিন্তু যদি বলা হয় শুধুমাত্র প্রতারণার জন্য আমেরিকার কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা- এফবিআই এর মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় কারও নাম থাকে, তাহলে একটু অবাক হতেই হয়।
সেই সঙ্গে যদি অপরাধী কোন নারী হন, তাহলে বিষ্ময়ের ঘোর তৈরি হতেই পারে। হ্যা, ঠিকই শুনছেন।
এফবিআই এমনই এক নারী বহু বছর ধরে খুঁজছে, যার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছেন বহু মানুষ। পথের ফকির বানিয়ে ছেড়েছেন অনেককেই।
এফবিআই-এর ৭২ বছরের ইতিহাসে মাত্র ১১ জন নারীর উঠেছে তাদের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায়। সবশেষ যে নারীর নাম এই তালিকায় উঠেছে, তার নাম রুজা ইগনাতোভা। কে এই রুজা, তা জানার আগে পরিচিত হওয়া যাক তার অপরাধের সঙ্গে।
এফবিআই বলছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল, এই দুই বছরের মধ্যেই রুজা তার ভুয়া এক কোম্পানির মাধ্যমে ধনীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন চার বিলিয়ন ডলার।
এরপরই এফবিআই-এর মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় নাম উঠে যায় রুজার। সংস্থাটির মতে, ডিজিটাল কারেন্সি বা ক্রিপ্টো কারেন্সির জগতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর এই খেলোয়াড় হলেন রুজা ইগনাতোভা। এজন্য তাকে বলা হয় ‘ক্রিপ্টো কুইন’।
এফবিআই তালিকায় নাম ওঠার পর থেকেই, রুজা ভোজবাজির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যান। ২০১৭ সালের পর থেকে তাকে আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায়নি। পায়নি এফবিআইও।
শেষবার রুজাকে একটি বিমানের মধ্যে দেখা যায়। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী তদন্ত সংস্থার বাঘা বাঘা ডিটেকটিভরা।
রুজার অনুপস্থিতিতেই ২০১৯ সালে অর্থ জালিয়াতি, ডিজিটাল জালিয়াতি এবং অর্থপাচারের তিনটি অভিযোগ আনে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আসামিই তো ফেরার, তাহলে বিচার হবে কী করে। তাই রুজা দাম উঠেছে রেকর্ড ৫০ লাখ ডলারে।
অর্থাৎ, কেউ রুজা ইগনাতোভাকে ধরিয়ে দিতে পারলে, তাকে এই পরিমাণ অর্থ দেবে এফবিআই। কিন্তু তা এখনও কেবলই স্বপ্ন। রুজার অবস্থান সম্পর্কে বলতে গেলে বোন তথ্যই নেই আমেরিকাসহ বিশ্বের কোনও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।
এফবিআই ধারণা করছে, প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে রুজা তার চেহারা পুরো পাল্টে ফেলেছেন। ফলে তাকে এখন চেনার উপায় নেই। রুজাকে খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে এটিই বড় চ্যালেঞ্জ।
গত সাত বছর তাঁর পেছনে ধাওয়া করছে এফবিআই। তাদের সঙ্গে আছে কানাডা ও ইউরোপের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও। তবু তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি- ‘ক্রিপ্টো কুইন’ রুজা ইগনাতোভা।
কিন্তু, তিনি কী দোষ করেছেন? বুলগেরিয়ায় জন্মালেও জার্মান নাগরিক রুজা ২০১৪ সালে সোফিয়াতে ‘ওয়ানকয়েন’ নামে এক জাল ক্রিপ্টোকারেন্সি সংস্থা খুলে ব্যবসার ফাঁদ পেতে ছিলেন।
দারুণ সুন্দরী রুজার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ ছিলো তার রূপ। সেই রূপের টানে মোহিত করেই ক্লায়েন্টদের জাল ক্রিপ্টো কারেন্সিতে বিনিয়োগ করাতেন তিনি। পরে সেই টাকা নিয়ে কেটে পড়তেন তিনি।
এভাবে এই সুন্দরী নারী চারশ’ কোটি ডলারের বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন রুজা। যাকে মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলছে, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জালিয়াতি। যার ফাঁদে পড়ে পথের ফকির হয়েছে আমেরিকার অনেক ধর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী।
আমেরিকার পাশাপাশি, বুলগেরিয়া গোয়েন্দা বিভাগও রুজাকে গরু খোঁজা খুঁজছে। কিন্তু, গত সাত বছর ধরে তাদের চোখে ধুলো দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছেন তিনি। তাকে শেষবার প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর।
বুলগেরিয়া থেকে গ্রিসের উদ্দেশে রওনা দেন রুজা। গ্রিসের এথেন্সে তাঁকে কেউ কেউ দেখেছেন। এরপর যেন রীতিমতো হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন এই সুন্দরী নারী।
এফবিআই মনে করে, জার্মান পাসপোর্ট ব্যবহার করে রুজা সম্ভবত গ্রিস, আরব আমিরাত, রাশিয়া কিংবা পূর্ব ইউরোপের কোনও দেশে আছেন। প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা বদলেও ফেলে থাকতে পারেন ক্রিপ্টোকুইন।
রুজার সঙ্গে সবসময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীও থাকতে পারে। তবে, তিনি কোন ব্যাংকিং চ্যানেলই লেনদেন করেন না। তার নামে কোন ব্যাংক কার্ডের অস্তিত্ব এখনও খুঁজে পায়নি গোয়েন্দারা।
একবার রুজাকে ধরার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল এফবিআই। তাঁর মার্কিন বয়ফ্রেন্ডকে কাজে লাগিয়েছিল সংস্থাটি। কিন্তু, রুজা তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে পা রেখেই বুঝে যান তিনি এফবিআই-এর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে পালিয়ে যান।
এরপর থেকে রুজার আর কোন হদিস পায়নি গোয়েন্দারা। না পেয়ে তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য আড়াই লাখ ডলার থেকে পুরস্কারের অর্থ ৫০ লাখ ডলারে উন্নতি করে এফবিআই।
রুজাকে ধরতে না পারলেও, তার ওয়ানকয়েনের বেশ ক’জন অংশীদারকে পাকড়াও করে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। ওয়ানকয়েনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা কার্ল গ্রিনউডকে ২০২৩ সালে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ৩০ কোটি ডলার বাজেয়াপ্ত করা হয়।
বুলগেরিয়ার নাগরিক ইরিনা দিলকিনস্কা এবং মার্কিন নাগরিক মার্ক স্কটকে যথাক্রমে চার র এবং দশ বছরের সাজা দেয়া হয়। তবে, ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছেন রুজা।
জেএন/পিআর