সত্তর-আশির দশকে দাবা মানেই নিয়াজ মোর্শেদের একক প্রাধান্য ও আধিপত্য। ১৯৮৮ সালে ১৪ বছরের কিশোর জিয়াউর রহমান জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৭৯ সালে নিয়াজ মোর্শেদ মাত্র ১৩ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। এর পরই জিয়ার অবস্থান।
নিয়াজ মোর্শেদের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। ২০০২ সালে জিএম টাইটেল পেলেও ততদিনে জাতীয় দাবায় ছয়বার শিরোপা জেতেন। গ্র্যান্ডমাস্টার টাইটেল জিতেই অনেক দাবাড়ু ক্ষান্ত হন। জিয়া সেই ধাঁচের নয়। জাতীয় দাবার ৪৭ আসরের মধ্যে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বারের চ্যাম্পিয়ন। আজ চলে যাওয়ার দিনেও ছিলেন দ্বিতীয় পজিশনে। দাবার বোর্ডে লড়তে লড়তেই দুনিয়া ছাড়লেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান।
সবচেয়ে বেশিবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নই জিয়ার দাবার মাহাত্ম্য পুরোটা প্রকাশ করে না। নিয়াজ, রিফাত, রাকিব অন্য তিন গ্র্যান্ডমাস্টার দাবা পুরোদস্তুর পেশা হিসেবে নেননি। জিয়ার কাছে দাবাই ছিল ধ্যানজ্ঞান। নিজে খেলেছেন, দাবাড়ু তৈরি করেছেন। দাবাটাই ছিল তার জীবন।
একমাত্র ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়াও দাবাড়ু। তিনিও বাবার সঙ্গে সঙ্গে অলিম্পিয়াড খেলার কৃতিত্ব গড়েছেন। বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্ব দাবায় এমন ঘটনা বেশ বিরলই! জিয়ার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা বিসিএস ক্যাডারে যোগ দেননি শুধু স্বামীর দাবায় ব্যাঘাত ঘটবে বলে। দাবা তো বটেই, দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এমন পরিবার পাওয়া খুবই দুষ্কর।
কোচিং পেশা হলেও খেলাটাই জিয়ার বাড়তি পছন্দ। বয়সের কোটা হাফ সেঞ্চুরি হলেও দাবা বোর্ডে বেশ নির্ভারই থাকেন। বাংলাদেশের অনেক খেলায় খেলোয়াড়দের ধারাবাহিকতার অভাব। জিয়া সেখানে ভিন্ন পথের পথিক। জাতীয়-আর্ন্তজাতিক অনেক টুর্নামেন্টে হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। দাবা ফেডারেশনে মজাচ্ছলে বেশ কয়েক বারই বলতেন, ‘আমার এত ট্রফি যে শোকেজ বার বার কিনতে হয়।’ জাতীয়-আন্তর্জাতিক সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে শতবারের কাছাকাছি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব রয়েছে তার। দাবা অঙ্গনের অনেকের তথ্য, গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াই সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়াবিদ যিনি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে খেলেছেন।
দাবার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট অলিম্পিয়াড। সেই অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের নিয়মিত মুখ ছিলেন জিয়া। জাতীয় দাবায় শীর্ষ পাঁচ দাবাড়ু অলিম্পিয়াডে খেলার সুযোগ পান। জিয়া জাতীয় দাবায় শীর্ষ পাঁচ হননি এমন রেকর্ড খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিশ্বকাপ-অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের ভরসা ছিল জিয়ার বোর্ড।
ক্রীড়াঙ্গনে অনেকেই খেলতে গিয়ে পড়াশোনা বিসর্জন দেন। জিয়াও সেখানেও অন্য পথের পথিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান থেকে স্নাতক করেছেন। ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদানের জন্য জিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু বেজ পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রাখায় ক্রীড়া পুরস্কার, ক্রীড়া লেখক সমিতি, ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা স্বীকৃতি পেয়েছেন নানা সময়ে।
রেকর্ড-অর্জন-নিবেদন সব কিছুতেই জিয়ার অবস্থান উঁচুতে। এ সব ছাপিয়ে ব্যক্তি জিয়া আরেকটু উঁচু কাতারে। দাবার এতবড় মহীরুহ কিন্তু কখনোই বিন্দুমাত্র অহংকার ছিল না। টাইটেলহীন দাবাড়ুদের চালও দেখতেন মনোযোগ দিয়ে। আচারব্যবহার ও চলাচলে বরাবরই ভদ্রতা-রুচিশীলতা। পরিচিতি গোত্রের মধ্যে অবশ্য রসিকতায় মেতে উঠলেও জিয়া মূলত রাশভারী। চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে একেবারে চুপিচুপিই দুনিয়া ছাড়লেন! দাবা বোর্ডে নানা রেকর্ডের মতো পরপারের তালিকাও তিনি বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার।
জেএন/এমআর