বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) প্রশ্নফাঁসে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার চক্রটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ কয়েকটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে যুক্ত ছিল। এর মধ্যে গত বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করে তারা। এ নিয়ে তখন অনেক তথ্য-উপাত্ত সামনে আসে।
সংক্ষুব্ধরা পিএসসিতে স্মারকলিপিও দেন। তবে দায়িত্বশীল কেউ প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি স্বীকার করেননি। এবার চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে বেরিয়ে আসে ফাঁসের তথ্য।
এদিকে পিএসসির ভেতরে-বাইরে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল চক্রটি। ফলে সুরক্ষিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে প্রশ্ন বের করে আনা এবং টাকার বিনিময়ে তা পরীক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন হতো। নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তি করত তারা। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীর প্রবেশপত্র, আইডি ও পাসওয়ার্ড থাকত চক্রের কাছে। যেন চাইলেও কোনো পরীক্ষার্থী তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে না পারেন।
পিএসসির প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে রোববার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যানের চাকরিচ্যুত গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
তাদের মধ্যে পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামকে বুধবার সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনায় পল্টন থানায় দায়ের মামলায় আবেদসহ ছয়জন মঙ্গলবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে গ্রেপ্তার সবাইকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) আজাদ রহমান বলেন, আসামিদের জবানবন্দিতে বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। তবে সেগুলো থেকে এখনই সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে জবানবন্দি না দেওয়া আসামিদের মধ্যে ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে সিআইডি।
তদন্ত সূত্র জানায়, পিএসসির সুরক্ষিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকে মূলত উপপরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম প্রশ্ন বের করে আনতেন। এর পর সেই প্রশ্ন পেতেন সাজেদুল ইসলাম। তিনি আবেদ আলীকে টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র সরবরাহের পাশাপাশি দুই উপপরিচালকের পক্ষে তিনটি চক্র পরিচালনা করতেন। তাঁর সহযোগীরা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন কিনতে আগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। কথা চূড়ান্ত হলে প্রার্থীদের সাজেদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হতো। এ ধরনের পরীক্ষার্থী সংগ্রহকারীদের অন্যতম ছিলেন খলিলুর রহমান। রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি ৯৮ জন প্রার্থী দেন। ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মী মামুনুর রশীদও পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতেন। এভাবে চুক্তিবদ্ধ সব প্রার্থীকেই বিভিন্ন স্থান থেকে মাইক্রোবাসে তুলে সাজেদুলের নির্ধারিত বাসা বা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে নেওয়া হতো। এর পর সেখানেই তাদের প্রশ্নপত্র ও উত্তর দিয়ে মুখস্থ করতে বলতেন চক্রের সদস্যরা।
তথ্য মতে, রেলের নিয়োগ পরীক্ষায় অন্তত ২০০ জনকে এভাবে পরীক্ষা দেওয়ানো হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৭-১৮ লাখ টাকা নেওয়ার চুক্তি হয়েছিল। প্রতি চাকরিপ্রার্থী থেকে আদায় করা টাকার অর্ধেক পেতেন দুই উপপরিচালক। আবু জাফর ও আলমগীর কবির তাদের মালিকানাধীন কোচিং সেন্টার থেকেও প্রশ্ন বিক্রি করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একই কৌশলে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর নিয়োগের প্রশ্ন ফাঁস
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একই কৌশলে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করা হয়। তখন পরীক্ষার্থীরা প্রমাণসহ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন। আশিকুজ্জামান নয়ন নামে এক পরীক্ষার্থী তখন জানান, ২০২১ সালের অক্টোবরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় (পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও টেকনিক্যাল স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে) জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে পরীক্ষার জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। প্রায় দেড় বছর পর গত বছরের ১৮ মার্চ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এর আগের রাতে আবিদ শাহরিয়ার আহমেদ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে ওই পরীক্ষার পুরো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এ প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষায় সরবরাহ করা প্রশ্নের হুবহু মিল ছিল।
সিআইডি সূত্র জানায়, চক্রের সদস্যদের হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন থেকে প্রশ্ন ফাঁস সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া মিলেছে বেশ কিছু ডিজিটাল আলামত। পরীক্ষার্থীদের নিজস্ব ইউজার আইডি ও গোপনীয় পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করতেন চক্রের সদস্যরা। ফলে পরীক্ষার ফল বের হলে তারা সহজেই জেনে যেতেন কে কে পাস করেছে। এতে তাদের কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী বাকি টাকা আদায় সহজ হতো। এই চক্রের কাছে দুটি বিসিএস পরীক্ষার শত শত প্রবেশপত্রের ফটোকপি পাওয়া গেছে।
ফাঁস হওয়া প্রশ্নে চাকরি পাওয়ারা নজরদারিতে
ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া বেশ কয়েকজনের নাম-পরিচয় পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। তাদের নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে। এ ছাড়া পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার তথ্যও সামনে এসেছে। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন কার জিম্মায় থাকত, কার মাধ্যমে কেন্দ্রে পৌঁছাত– এসব প্রশ্নের উত্তর মিলেছে সাজেদুল ও খলিলুরের কাছ থেকে।
অষ্টম শ্রেণি পাস ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন মানুষকে পাইয়ে দিতেন বিভিন্ন সরকারি চাকরি। জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী, তিনি ঢাকা শহরের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, ভাড়া বাসা ও নিজের গুদামে পরীক্ষার আগের রাতে প্রার্থীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে যেতেন তিনি। পরে সেসব প্রশ্নের সমাধান করে পরীক্ষার্থীদের দিতেন।
সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সাখাওয়াত কয়েকদিন পর পর দেশের বাইরে পরিবারসহ বেড়াতে যান। অভিযানে তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, কানাডার ১০ বছরের ভিসা রয়েছে। এ ছাড়া লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা রয়েছে তাঁর।
পিএসসির কেউ কোচিং ব্যবসা করলে ব্যবস্থা
পিএসসির উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পিএসসির কেউ কোচিং ব্যবসা বা প্রেসের মালিকানায় যুক্ত থাকলে বরখাস্ত করা হবে। কয়েকজনের কোচিং ব্যবসা এবং কারও প্রেস আছে বলে এরই মধ্যে তথ্য মিলেছে। প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়ে এগুলো করে থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হলে তাদের বরখাস্ত করে বিভাগীয় মামলা করা হবে। এ ছাড়া সন্দেহের তালিকায় কারও নাম এলেই তাকে দায়িত্ব থেকে নিষ্ক্রিয় রাখা হবে। প্রয়োজনে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
জেএন/এমআর