চুরি আসলে এক ‘চমত্কার’ আর্ট,একজন আবেদ আলী

চিররঞ্জন সরকার

চুরি আসলে এক ‘চমত্কার’ আর্ট। কমবেশি অনেকেই এ বিদ্যা চর্চা করে। কিন্তু ধরা পড়ে খুব কম জনই। আর এর সুবিধা হলো, ধরা না পড়া পর্যন্ত কাউকে চোর বলাও যায় না! এমনিতে চুরিটা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এমনভাবে মিশে গেছে, এ নিয়ে কেউ তেমন আর মাথা ঘামায় না।

- Advertisement -

তবে মাঝেমধ্যে দু-একটি বড়ো চুরির ঘটনা ধরা পড়ে বা উদ্ঘাটিত হয়। তখন আমরা খানিকটা হইচই করি। ধর্মের বাণী স্মরণ করি। ব্যস। তারপর যেই লাউ সেই কদু। আমরা আবার চুরির মওকা খুঁজি। চুরি বিদ্যার চর্চা অব্যাহত রাখি।

- Advertisement -google news follower

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ নানা দিক থেকেই অনন্য, অসাধারণ। চুরি করে বড়লোক হওয়ার মতো এমন সুন্দর অনুকূল পরিবেশ পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে বলে মনে হয় না। তাই তো এখানে কমবেশি সবাই বড়লোক হওয়ার বাসনায় চুরি করেন। ঘুষ খান, দুর্নীতি করেন।

অবৈধ পন্থায় ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে আমাদের দেশে টাকা উপার্জন অনেকেই করেন। শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তাদের মধ্যে ধরা পড়ে কয়জন? ঢাকা শহরের এমন অনেক আলিশান বাড়ি ও দামি গাড়ির মালিকের খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের এ অর্জন অবৈধ পন্থায়, ঘুষ-দুর্নীতির টাকায়।

- Advertisement -islamibank

এরটা মেরে, ওরটা কেড়ে, ঠকিয়ে-প্রতারণা করে, বিপদের সুযোগ নিয়ে, ফাঁসিয়ে দিয়ে কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির চোরাপথ ছাড়া এদেশে বড় ধনী হওয়া যায় না। আর সেটা সবাই পারেও না। আসলে টাকা উপার্জন করাটা যেমন একটা আর্ট, উপার্জিত টাকা সবার অগোচরে ‘সংরক্ষণ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ’ করতে পারাটাও একটা আর্ট।

এই আর্ট সবাই রপ্ত করতে পারে না। এর জন্য সাধনা লাগে। দক্ষতা অর্জন করতে হয়। ম্যানেজ করতে জানতে হয়। পুকুর চুরি করে সেই পুকুর আড়াল করে রাখা কিংবা গায়েব করে দেওয়াটা সহজ বিদ্যা নয় মোটেই।

অনেকেই সেটা পারেন ও করেন। কিন্তু আমাদের সমাজে কিছু কিছু আনাড়ি চোরও আছে। ইদানীং তাদের কারো কারো নাম পত্রিকায় আসছে।

আসলে সমাজ-সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চুরিচামারির ধরন-ধারণও বদলে গেছে। আগে চুরিচামারির একটা সীমারেখা ছিল। চোরেরও একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। তখন ছিঁচকে চুরিই ছিল বেশি। বড় ধরনের চুরি কেউ করত না কিংবা করার সাহস পেত না। বড় ধরনের চুরি বা লুটপাটকে বলা হতো ‘পুকুর চুরি’।

এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কিছু ক্ষেত্রে যে লুটপাট চলছে, তা শুধু পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি। অর্থাত্, এখন চুরি আর পুকুরে সীমাবদ্ধ নেই, সাগর চুরি শুরু হয়েছে। আগে কিছু নির্দিষ্ট মানুষই চুরি করত। এর মধ্যে রাজকর্মচারীরা ছিল অগ্রগণ্য।

এখন রাজকর্মচারীরা তো বটেই, চান্স পেলে পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজ, মালি, মুটে, ঝাড়ুদার, পাহারাদার, পিয়ন-চাপরাশি, গাড়িচালক—যে কেউই চুরি করে বা করতে পারে। এখন সমাজে পেশা দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে পুকুর বা সাগর চুরি করেছে কি না। সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে এ এক বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা!

সম্প্রতি সারা দেশে হয়ে উঠেছেন আবেদ আলী। ভালো নাম সৈয়দ আবেদ আলী। রীতিমতো ‘সৈয়দ’ বংশের সন্তান। একসময় নিজ গ্রামে মাটি কাটা শ্রমিকের কাজ করতেন আবেদ আলী। চাকরির খোঁজে রাজধানীতে এসে ফুটপাতে শুয়েও পার করেছেন রাতের পর রাত। বহু চেষ্টা-তদবিরে একসময় ভাগ্য খোলে আবেদের।

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) পরিচালকের গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পান পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়ি চালানোর।

আরব্য রজনির রূপকথার আলাদীন যেমন জাদুর চেরাগ পেয়ে শূন্য থেকে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি গাড়িচালকের চাকরি পেয়ে শূন্য থেকে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন আবেদ।

যিনি নিজে গাড়িচালক ছিলেন, সেই আবেদ আলীর নিজেরই এখন রয়েছে কয়েক জন গাড়িচালক। ৩৩তম থেকে ৪৫তম বিসিএস পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁসের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত চক্রে সক্রিয় ছিলেন আবেদ আলী।

এভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা বাগিয়ে হয়ে গেছেন গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক। গ্রামে তৈরি করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। পাশে নিজের নামে তৈরি করেছেন মসজিদ। রয়েছে ডেইরি ফার্ম ও বাগানবাড়ি। রাস্তার পাশে সরকারি জায়গা দখল করে তৈরি করেছেন মার্কেট।

নিজ এলাকায় শত বিঘার ওপরে জমি কেনার পাশাপাশি কুয়াকাটায় তৈরি করেছেন থ্রি স্টার হোটেল সান মেরিনো। ঢাকার মিরপুর ও উত্তরায় রয়েছে দুটি বহুতল বাড়ি। তথ্য বলছে, ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তার রয়েছে অন্তত সাতটি ফ্ল্যাট এবং তিনটি প্লট।

অনেকেই তাকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যদিও বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখার ও ভাবার অবকাশ আছে। আবেদ আলী আসলে একজন প্রথাবিরোধী ব্যতিক্রমী মানুষ। দামি গাড়ি, বিলাসবহুল বাড়ি শুধু সমাজ বা অফিসের উঁচুতলার মানুষের জন্য, এই প্রচলিত ধারণা তিনি বদলে দিয়েছেন।

নিজে ‘শোষিত-বঞ্চিত’ শ্রেণির প্রতিভূ হয়েও রাষ্ট্রীয় সম্পদ করায়ত্ত করেছেন। নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা-প্রতিভা দিয়ে তিনি ধনিক গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছেন। নিজের ভাগ্য বদল করেছেন।

কেবল গাড়িচালক নয়, সমাজে একজন সফল ধনী মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশের কতজন মানুষ তার মতো টাকা বানাতে পেরেছে?

বাড়ির সিংহ দরজার চেহারা দেখলেও মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়। তার রুচির প্রশংসা করতে হয়। তার নিশ্চয়ই অনেক এলেম আছে। না হলে স্রেফ গাড়িচালক হয়ে এত সম্পদ অর্জন করলেন কী করে? সমাজে পরাজিত ব্যর্থ মানুষেরাই আজ তার বিরোধিতা করছে।

কিন্তু তার এই বিপুল সম্পদ তো আর এমনি এমনি হয়নি। তাকে এগুলো কেউ স্বেচ্ছায়ও দেয়নি। একজন বড় কর্মকর্তার গাড়িচালক বলে খুশি হয়ে সবাই তাকে টাকাপয়সা উপহার দিয়েছে এমনও নয়।

এর জন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। এরটা মেরে, ওরটা কেড়ে সমাজে ধনী হওয়া সহজ কাজ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার জন্য তাকে নিশ্চয়ই অনেক আত্মত্যাগ ও স্বার্থত্যাগ করতে হয়েছে।

নিজে যা উপার্জন করেছেন, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সুবিধা অন্য কাউকে পাইয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ার নিয়মই হচ্ছে :দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে! নিজে কিছু পেতে হলে অন্যকেও অনেক কিছু দিতে হয়। তিনি দিয়েছেন ও পেয়েছেন। বর্তমান যুগে সফল হওয়া, কোটিপতি হওয়া, বড়লোক হওয়াই তো সব দেশের, সব মানুষেরই আদর্শ।

টাকাওয়ালা হতে পারার নামই সাফল্য। সফল হওয়ার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। উপায় এখন কেউ দেখে না। উদ্দেশ্য আর ফলটাই দেখে। যারা নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রেখে নিয়মিত সরাতে পারে, তারাই প্রকৃত জ্ঞানী।

আবেদ আলী কে? বড়বাবুর নানা মাপের ক্যাশিয়ার বা টোল কালেক্টরদের একজন। বেহিসাবি বস্তার ছিদ্র থেকে টুকটাক সরিয়ে যত্সামান্য কিছু করেছেন।

একদিক দিয়ে দেখলে আবেদ আলী খুব ভালো কাজ করেছেন। নিজের উন্নতির জন্য কাজ করেছেন। এখন তো আমরা উন্নতিই চাই। আর সেটা আত্মিক বা নৈতিক উন্নতি নয়, আর্থিক উন্নতি।

আর্থিক উন্নতি যে পথে হয়, সে পথে চলাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। নিজের আখের গোছাতে সবাই চেষ্টা করে। কেউ পারে, কেউ পারে না। যারা পারে বা পারছে, তাদের কি আমরা মাথায় তুলে রাখছি না?

নীতি-আদর্শ তো এখন কেবলই মুখের বুলি। অপকর্ম করে যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ ধরা না খায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তো সবাই সাধু পুরুষ। ধরা না-খাওয়া পর্যন্ত, সুশীল রাজনৈতিক কর্মী, ত্যাগী যোদ্ধা, সমাজের মাথা, হাজার মানুষের আইডল, মোটিভেশনাল স্পিকার, টক শোর জ্ঞানতাপস, কমিউনিটির বাতিঘর! তারপর একদিন হয়তো সবকিছু ফাঁস হয়, সাধক পরিণত হন মহাপাতকে। তবে সবাই নন, কেউ কেউ। ইত্তেফাক

আসলে সবাইকে টেক্কা দিয়ে অঢেল অর্থ-সম্পদ অর্জনের খেলায় এগিয়ে যাওয়াই তো স্পোর্টিং স্পিরিট! আর জীবনযুদ্ধ তো প্রতিযোগিতারই নামান্তর।

তাহলে কেন বন্ধ হবে এই খেলা? শুধু দু-এক জন ভুল শট খেলে অতিআগ্রাসী হয়ে অসময়ে আউট হয় আরকি! এটা সব খেলাতেই হয়!

বাংলাদেশ আসলে ধনী তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। এই কারখানা থেকে নিয়মিত ধনী উত্পাদিত হচ্ছে, এটা আমাদের জন্য অবশ্যই সুখবর। বেনজীর, মতিউর, ফয়সল, আবেদ আলীরা হচ্ছেন এই কারখানার শ্রেষ্ঠ পণ্য!

আগামী দিনে স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে এই সব সফল মানুষের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। জীবনে কীভাবে নিচু থেকে ওপরে ওঠা যায়, সেটা আগামী দিনের নাগরিকদের অবশ্যই জানা দরকার!

লেখক: রম্যরচয়িতা

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM