নিষেধাজ্ঞা চলমান/এত সামুদ্রিক মাছ আসে কোত্থেকে?

রাজীব সেন প্রিন্স :

মাছের ভরা প্রজনন মৌসুমে সামুদ্রিক মাছের বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে সরকার সমুদ্রে সকল প্রজাতির মাছ শিকারে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সে নিষেধাজ্ঞা উঠতে আরও ৮দিন বাকি।

- Advertisement -

চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সাগর থেকে মণকে মণ মাছ নিয়ে ঘাটে নোঙর করছে শত-শত ফিশিং ট্রলার। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, চলমান নিষেধাজ্ঞার মাঝেই এত সামুদ্রিক মাছ আসে কোত্থেকে?

- Advertisement -google news follower

খোজ নিয়ে জানা যায়, জেল-জরিমানা এবং অর্থদণ্ডের তোয়াক্কা না করে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবাধে চলছে মাছ শিকার।

বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বঙ্গোপসাগরের বাঁশখালী-কুতুবদিয়া চ্যানেলের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে রাতের অন্ধকারে মাছ শিকারের তথ্য পাওয়া গেছে।

- Advertisement -islamibank

আহরিত মাছ রাতের বেলায় বন্দরে উৎসবের আমেজেই হচ্ছে বেচা বিক্রি। আবার তা যাত্রীবাহী বাস ও পিকআপ যোগে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন মোকামে।

অনুসন্ধানে এমনই ৫টি ঘাটের সন্ধান মেলে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। এ পাঁচ স্পটে সমুদ্র উপকূলে শতাধিক ফিশিং বোট প্রতিদিন সামুদ্রিক মাছ খালাস করছে। সাগর মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত জলসীমায় রীতিমতো মাছ শিকার ও বেচা-বিক্রির মহোৎসব চলে।

জানা গেছে, উপজেলার শেখেরখীল ফাঁড়ির মুখ, চাম্বল বাংলাবাজার, ছনুয়া-কুতুবদিয়া ঘাট, খানখানাবাদ, কদমরসুল পয়েন্টে সামুদ্রিক মাছ বিক্রির জন্য স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ঘাটে ঘাটে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট।

এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাছ উঠে যাচ্ছে ক্রেতাদের হাতে। প্রতিরাতে মাছ বোঝাই করে বাঁশখালীর প্রধান সড়ক হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চালান দেওয়া হচ্ছে। কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার সুযোগ নিয়ে রমরমা ব্যবসা পরিচালনা করার অভিযোগও পাওয়া গেছে।

স্থানীয় জেলেরা জানান, প্রভাবশালী ‘বহদ্দারদের’ চাপের মুখে উপকূল ছেড়ে বেশ কয়েকটি ফিশিং বোট নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে গেছে শত শত মাঝিমাল্লা।

মাছ ধরতে না গেলে প্রভাবশালী বহদ্দারদের চাপে পড়তে হয় সাধারণ জেলেদের। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই বন্ধের মাঝেও মাছ ধরতে যান বলেও জানান তারা।

মাছ ঘাটগুলোতে মৎস্য বিভাগের শক্ত কোন নজরদারি না থাকায় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অধিকাংশ ট্রলার দিয়েই সমুদ্রে মাছ ধরা অব্যাহত রয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার সময় অবাধে এমন মাছ শিকারের ফলে একসময় সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হওয়া এবং মাছের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে।

চাম্বল বাংলাবাজার এলাকার জেলে সাগর দাস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কুচক্রিমহলের ইন্ধনে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী জোর পূর্বক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সমুদ্রে মাছ শিকারে পাঠাচ্ছে জেলেদের।

এ ধরনের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্তাদের অবহিত করা হলে তাদের আইনের আওতায় আনার গতানুগতিক আশ্বাসের মধ্যেই আটকে থাকে। যদিও মৎস্য অধিদপ্তরের কর্তারা বলছেন, অভিযান অব্যাহত আছে।

উপজেলার কদমরসুল পয়েন্টে সরেজমিনে গিয়ে মাছ শিকার অবস্থায় কয়েকজন জেলেকে প্রশ্ন করলে কেউ কেউ অকপটে শিকার করলেন নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা ও বেচা-বিক্রির কথা।

আবার কয়েকজন জেলের মুখে শোনা যায় তাদের অসহায়ত্বের কথা। তারা বলেন, ‘এখন তো মাছ ধরা নিষেধ, কিন্তু আমাদের তো বাঁচতে হবে। আমরা মাছ ধরি, আমাদের বেতন দেয়। মাছ ধরা বন্ধ থাকলে আমরা তো সরকার থেকে কোনো ভাতা পাই না। তাহলে আমরা চলবো কীভাবে?

বাঁশখালীর সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, লোকবল ও সরঞ্জাম সংকট থাকলেও নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে তৎপর তারা।

বলেন, বিশাল সমুদ্রসীমা পাহারা দেয়ার জন্য যে জনবল দরকার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঘাটতি আছে। এজন্য ২৪ ঘণ্টা খুব কঠোরভাবে এই ব্যবস্থা করতে পারছি না। তবুও আমরা অভিযান চালাচ্ছি।

এ মৎস্য কর্মকর্তা জানান, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আহরণকৃত মাছ রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহের দায়ে গেল কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়।

অভিযানে শত শত মণ সামুদ্রিক মাছ, মাছ বোঝাই বোট ও পরিবহনের দায়ে বেশ কয়েকটি ট্রাক জব্দ করে প্রশাসন ও মৎস্য দপ্তর। জরিমানাও করা হয় লক্ষ লক্ষ টাকা।

সবশেষ গতকাল রবিবার (১৪ জুলাই) বঙ্গোপসাগরের বাঁশখালী চ্যানেলের বিভিন্ন পয়েন্টে উপজেলা মৎস্য দপ্তর ও কোস্টগার্ড যৌথ অভিযান চালায়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তারের (ইউএনও) নির্দেশনায় পরিচালিত এ অভিযানে ৪টি বোটসহ চার হাজার ৬শ কেজি মাছ জব্দ করা হয়েছে। সেখান থেকে ৫শ কেজি মাছ স্থানীয় ২৫টি এতিম খানায় বিতরণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট মাছ প্রকাশ্যে নিলামে ৪ লক্ষ ৪৬ হাজার ২শ টাকায় বিক্রি করা হয়।

তাছাড়া চারটি বোট মালিককে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সেই সঙ্গে চিংড়ি পোনা ধরতে অবৈধভাবে বসানো ৫ হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের ৫টি মশারি নেট জব্দ করে পোড়ানো হয়।

একই অভিযানে আল্লাহ মালিক নামক একটি যান্ত্রিক মৎস্য নৌযানে অবৈধভাবে বসানো ট্রলিং সিস্টেম ও ট্রলডোর অপসারণ করে নৌযানটির মালিককে ২ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। বলেন অভিযান অব্যাহত থাকবে।

অভিযানে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের কন্টিজেন্স কমান্ডার মো. মিজানুর রহমান, সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক মো. মনজুর আলম, আব্দুল কুদ্দুস, মেরিন অফিসার সাইফুল ইসলাম, ইনুমেটর মো. আলমগীর উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, সমুদ্রে মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন বৃদ্ধি, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য প্রতিবছরের মতো এবারও ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। এসময় সমুদ্রে জাল ফেলে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ, চিংড়ি, হাঙ্গর, লবস্টার, কাঁকড়াসহ সাগরের কিছুই ধরা বারণ করে সরকার।

জেএন/পিআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM