পাচারে জড়িত দেশি-বিদেশী চক্র

কোকেন পাচারে ট্রানজিট বাংলাদেশ, গন্তব্য কোথায়?

রাজীব সেন প্রিন্স :

দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক একটি চক্র কোকেন পাচারের জন্য মাদকের নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশ (চট্টগ্রাম বিমান বন্দর) কেই ব্যবহার করছে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে একাধিক দেশ ঘুরে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে চলে যায় মাদকদ্রব্য কোকেনের চালান।

- Advertisement -

এই চক্রে বাংলাদেশি কয়েকজনের মধ্যস্থায় বেশ কয়েকটি বিদেশী নাগরিকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিশেষ করে আটলান্টিক মহাসাগরীয় দেশ বাহামা, আফ্রিকার নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, মালাউর, লাতিন আমেরিকার দেশ পেরু, ইউরোপের স্পেনসহ কয়েকটি দেশের তথ্য এসেছে বাংলাদেশ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।

- Advertisement -google news follower

সবশেষ গতকাল সোমবার সকালে চট্টগ্রাম শাহআমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বৃহৎ ৩ কেজি ৯শ গ্রামের কোকেনের চালানসহ আটক হয় বাহামার নাগরিক স্ট্যাটিয়া শানতাই রোলি। তার দেয়া তথ্য এবং সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে কোকেন জব্দের চার-পাঁচটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য উঠে আসে।

কোকেন পাচারে জড়িত বেশি বিদেশী নাগরিক :
ডিএনসির সূত্র বলছে, বাংলাদেশে মাদক চক্রে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা জড়িয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে কোকেনের চালান নিয়ে এ যাবৎ ধরা পড়া সব ঘটনায় বিদেশী নাগরিকরা জড়িত।

- Advertisement -islamibank

বাংলাদেশ হয়ে ভারত, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে কোকেন পাচার হচ্ছে। গেল প্রায় ১১ বছরে প্রায় ৬শ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৪৫ কেজি কোকেন ধরা পড়েছে। নানা ফৌজদারি মামলায় আসামি হয়েছেন ৩৪ দেশের ৭৩০ নাগরিক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাইজেরিয়ার ৯২ জন। এরপর রয়েছে পাকিস্তানের ২৮ ও ক্যামেরুনের ১৮ জন।

সবচেয়ে বৃহৎ চালানটি ধরা পড়ে ২০২৩ সালে। কোকেন চালানের প্রধান নাইজেরিয়ার নাগরিককে ১৩ কেজি কোকেনসহ আটক করা হয়েছিলো।

এরপর শত কোটি টাকা মূল্যের ৮ কেজি ৩শগ্রাম ওজনের কোকেনের চালানসহ আটক হয়েছিলো আফ্রিকার দেশ মালাউর একটি হাসপাতালের নার্স নোমথান্দাজো তাওয়েরা সোকো নামে এক নারী।

চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি এসব কোকেনসহ আটক হয় সে। পরে তার দেয়া তথ্যে কোকেন পাচার চক্রের ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এরমধ্যে বাংলাদেশি ছাড়াও ছিলেন মালাবি, ক্যামেরুন ও নাইজেরিয়ার বাসিন্দা।

তাছাড়া ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ৩ কেজি ৮০ গ্রাম কোকেনসহ স্পেনের এক নাগরিক আটক হয় শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকায়। ২০১৩ সালের জুনে কারওয়ান বাজারের একটি হোটেল থেকে তিন কেজি কোকেনসহ পেরুর এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছর চট্টগ্রাম বন্দরে ১০৭টি ড্রামে সূর্যমুখী তেলের সঙ্গে মিশিয়ে আনা কোকেনের চালান ধরা পড়ে।

কে এই শান্তে রোলি :
সবশেষ ধরা পড়া বৃহৎ কোকেনের চালানটিও একাধিক দেশ ঘুরে ভারতে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মিসেস স্টাসিয়া শান্তে রোলি (Statia Shatae Rolle)।

তিনি বাহামানিয়ানের একটি দোকানের বিক্রয়কর্মী হিসেবে কর্মরত। বয়স তার ৫৪। পাসপোর্ট নম্বর-AA163317।

স্বাভাবিকভাবে পাচারের কাজে বয়স্ক ব্যক্তি হলে সন্দেহ একটু কম হয়। তার ওপর নারী হলে তো কথায় নেই। সে সুযোগটাই নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারিরা। বেঁচে নিয়েছেন স্টাসিয়া শান্তে রোলিকে।

কোকেনের চালান যেভাবে নিয়ে আসেন রোলি :
গত শনিবার (১২ জুলাই) এমিরেটসের EK 262 ফ্লাইটে ব্রাজিলের সাওপাওলে থেকে দুবাই আসেন রোলি। সেখান থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে আসার কথা থাকলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে ফ্লাই দুবাইয়ের FZ 0563 ফ্লাইটে করে কোকেনের চালান নিয়ে চলে আসেন চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দর।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও রোলির লুকোচুরি :
রবিবার সকাল ৮টার দিকে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে অবতরণ করে মিসেস স্টাসিয়া শান্তে রোলির ফ্লাইট। এদিকে আগেই কোকেন পাচারের তথ্য চলে আসে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

তথ্যমতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, ডিবি পুলিশ ও এপিবিএন পুলিশ বিমান বন্দরে কোকেন বাহক মিসেস স্টাসিয়া শান্তে রোলির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

পাচারকারীরাও বিষয়টি বুঝতে পারেন। আর তাই ফ্লাইট থেকে নেমে কোনো ব্যাগেজ ছাড়াই বিমান বন্দর ত্যাগ করে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ হোটেলে উঠেন শান্তে রোলি। এদিকে তার পিছু ছাড়েনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাখেন নীবিড় নজরদারি।

গতকাল সোমবার বিমান বন্দরে তাঁর ব্যাগেজ ক্লেইম করেন রোলি। পরে অভিযানিক টিম কাস্টামস হাউজের সহযোগিতায় ব্যাগটি স্ক্যান করেন।

পরে ব্যাগটি তল্লাশি করে একটি কার্টুনের ভিতর ৭ টি আয়তকার পলি প্যাকেটের মধ্যে সাদা বর্ণের কোকেন সদৃশ পদার্থ পাওয়া হয়। প্রতিটি আয়তকার প্যাকেটে প্রায় ৫শ-৬শ গ্রাম করে ৭ টি প্যাকেটে মোট ৩ কেজি ৯শ গ্রাম সন্দিগ্ধ কোকেন জব্দ করা হয়।

যেভাবে নিশ্চিত করা হয়,এটি কোকেনের চালান :
শেষে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের পরীক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম সরকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে নিশ্চিত করেন জব্দ চালানটি কোকেনের।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ভাষ্য :
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম মেট্রো (দক্ষিণ) কার্যালয়ের উপপরিচালক রাজিব মিনা জানান, আন্তর্জাতিক কোকেন চোরা চালানকারী বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বহিনীকে এড়ানোর জন্য ঢাকার বিমান বন্দরের পরিবর্তে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর বেছে নিয়েছিল।

আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রোলি জানান, কোকেনের চালানের সাথে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক একটি চক্র জড়িত। তারা মাদকের নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশ (চট্টগ্রাম বিমান বন্দর) কেই বেঁচে নিয়েছিলো।

স্ট্যাটিয়া শানতাই রোলি চালানটির সাথে জড়িত বেশ কয়েকজনের সম্পৃক্তততার কথা জানিয়েছেন। তবে তদন্তের স্বার্থে ওই চক্রের দেশীয় সদস্যদের নাম জানাননি তিনি।

আটক আরও ২ নাইজেরিয়ান :
স্টাসিয়া শান্তে রোলির দেয়া তথ্যের সুত্র ধরেই তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আটক কোকেনের চালানের সাথে সম্পৃক্ত আরো কয়েকজনের অবস্থান নিশ্চিত করে অভিযানে নামে সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। সবশেষ ঢাকা থেকে ২ নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকার টিম।

ডিএনসির পরিদর্শক দেওয়ান জিল্লুর রহমান জানান, কোকেন পাচারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক একটি চক্রের আর্থিক নেটওয়ার্ক সম্পর্কেও তথ্য পায় ডিএনসি।

চক্রের হোতা নাইজেরিয়ান ডন ফ্রানকি ওরফে জ্যাকব ফ্রানকের পাঠানো অর্থ কয়েক হাত ঘুরে পৌঁছায় বাংলাদেশের সদস্যদের কাছে।

জব্দ কোকেন ও আটক বিদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ :
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো (উত্তর) কার্যালয়ের উপপরিচালক খন্দকার হুমায়ুন কবির জানান, প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে আটক তিন বিদেশীর বিরুদ্ধে ২০১৮ এর আইনের আওতায় পতেঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

কারা ছিলেন অভিযানে :
টানা কয়েকদিনের অভিযানে অংশ নেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম মেট্রো (দক্ষিণ) কার্যালয়ের উপপরিচালক রাজিব মিনা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো (উত্তর) কার্যালয়ের উপপরিচালক খন্দকার হুমায়ুন কবির, এপিবিএন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম মিজানুর রহমান, ঢাকা বিমানবন্দর-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জিয়াউল হক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকার বিমান বন্দর সার্কেলের পরিদর্শক জিল্লুর রহমান। অভিযানের সার্বিক তত্বাবধান করেন অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন মোল্লা।

জেএন/পিআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM