দুপুর থেকেই আইফেল টাওয়ার সংলগ্ন সেইন নদীর তীরে লোকে লোকারণ্য। আর একটু পরিষ্কার করে বললে অলিম্পিক গেমসকে কেন্দ্র করে ক্রীড়াবিদ, দর্শনার্থী ও অতিথিদের মিলনমেলা। ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ এর উদ্বোধন বলে কথা। ঘণ্টা চারেক সেইন নদীকে কেন্দ্র করে সবাই যেন বুঁদ হয়ে রইলো। এবারই ব্যতিক্রম এক চোখ ধাধানো উদ্বোধনের সাক্ষী হলো সবাই। যা অলিম্পিকের ইতিহাসে আগে কখনও দেখা যায়নি।
যদিও সকাল থেকে প্যারিসের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। আর আগে পরে মিলিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে বৃষ্টিতে ভিজেছে সবাই। এরমধ্যে বর্ষাতি পরা ফিফা সভাপতিকেও দেখা গেছে। দুশ্চিন্তাও দেখা দিয়েছিল ঠিকঠাক আয়োজন নিয়েও। অলিম্পিক গেমস শুরুর ঘণ্টা কয়েক আগে আগে দুষ্কৃতকারীদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্যারিসের দ্রুতগতির রেল নেটওয়ার্ক। কিছু ট্রেন যাত্রা বাতিলও করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে ঝামেলা পোহাতে হলেও দর্শকদের আসা বন্ধ করা যায়নি।
এতো দিন অলিম্পিকের উদ্বোধন মানেই ছিল স্টেডিয়ামের ভেতরে জমকালো সবকিছু। প্যারিস সেই ভাবনা থেকে সরে এসে এবার সবাইকে দারুণভাবে চমকে দিয়েছে। শহরের প্রধান নদী সেইনকে ঘিরে ছিল সবকিছু। সঙ্গে যোগ হয়েছে ঐতিহ্যবাহী আইফেল টাওয়ার।
বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হয় প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ফ্রান্সের অন্যতম সেরা ফুটবলার জিনেদিন জিদানের হাতে ছিল মশাল। যা তিনি তুলে দেন তিন শিশুর হাতে। তাদের হাত থেকে সেই মশাল চলে যায় এক অচেনা ব্যক্তির হাতে। গোটা অনুষ্ঠানে জুড়ে তাকে চেনা যায়নি, ঢাকা ছিল মুখ।
নদীতে সব অনুষ্ঠান হওয়ায় জায়ান্ট স্ক্রিনই ছিল বড় ভরসা। সেখানে শহরের বিভিন্ন স্থাপত্যকে তুলে ধরা হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে জল দিয়ে বিশেষ পর্দা তৈরি করা হয়েছিল। সেই পর্দা ভেঙে পন্ট ডি’ এলিনা ব্রিজের নিচ দিয়ে প্রথমে এগিয়ে এলো গ্রিস। এরপর এলো উদ্বাস্তুদের দল। আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলবেনিয়া, আলজেরিয়া, জার্মানি একটি বড় নৌকা করে একই সঙ্গে এলো। একে একে বিভিন্ন দেশের নৌকা যখন ওই জলের পর্দা ভেদ করে এগিয়ে আসছে, সেই সময় অন্য দিকে সুরের ভেলাতে ভেসেছেন লেডি গাগা। বাংলাদেশ দলও পাড়ি দিয়েছে সেইন নদী। আর্চার সাগর ইসলামের হাতে ছিল লাল-সবুজ পতাকা। সবার মধ্যে ছিল উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া।
সেইন নদীর ধারে বিশেষ তথ্যচিত্র দেখানো হয়। নোটরডামের সামনে পারফর্ম করলো মুল্যাঁ রুজ। ১৮২০-র দশকে সৃষ্ট বিশেষ নাচ আজ ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। ফরাসি ভাষা জানা জনপ্রিয় শিল্পী আয়া নাকামুরা পারফর্ম করলেন।
ফ্রান্সের অন্যতম সেরা সংগ্রহশালা গ্রাঁ প্যালাই থেকে জাতীয় সংগীত গাইলেন অ্যাক্সেল সাঁ-সিরেল। ফ্রান্সের ইতিহাসে ১০ জন সবচেয়ে বিখ্যাত নারীর মূর্তিও উন্মোচন করা হলো।
প্যারেডের শেষ তিন দেশ হিসেবে পরপর এলো অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ফ্রান্স। যারা ২০৩২ ও ২০২৮ এর অলিম্পিক আয়োজক। এর মধ্যে ফ্রান্সের নৌকাটি ছিল অন্যরকম। এ বার বিশেষ নৌকায় চলছে ফ্যাশন শো, কোনোটিতে নাচগান।
অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ঘোড়ায় চড়ে এক ব্যক্তি নিয়ে এলেন অলিম্পিকের পতাকা। আইফেল টাওয়ারের নীচে বিরাট সংখ্যক দর্শক তখন অপেক্ষা করছিলেন। তাদের সামনে উড়লো অলিম্পিক্সের পতাকা, গাওয়া হলো এই প্রতিযোগিতার থিম সং। প্যারিস অলিম্পিক আয়োজক কমিটির প্রধান টনি এস্তানগুয়েত এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স সংস্থার প্রধান থমাস বাক খেলোয়াড়দের শুভেচ্ছা জানানোর পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ প্যারিস অলিম্পিকের সূচনা করেন।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে অলিম্পিকের মশাল হাতে তুলে নেন জিদান। তার হাত থেকে আবার সেই মশাল নেন রাফায়েল নাদাল। নৌকায় করে সেই মশাল নিয়ে সেইন নদীর উপরে দেখা যায় নাদাল, সেরেনা উইলিয়ামস, কার্ল লুইসকে। আইফেল টাওয়ার জুড়ে তখন আলোর রোশনাই। গান গাইলেন সেলেন ডিওন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এখানেই শেষ। আজ থেকে পদক লড়াই শুরু। সেখানে নিশ্চয়ই আরও চমকের অপেক্ষা!
জেএন/এমআর