দেশের আর্থিক খাতের মূল নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রা সরবরাহ, মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বৈদেশিক মুদ্রার বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও বাংলাদেশ ব্যাংকের। গত ১৫ বছর এই সংস্থাটিতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ, নির্বাহী পরিচালকদের পদায়ন থেকে শুরু করে সবরকম নীতিমালা প্রণয়ন প্রভাবশালী এ দুই ব্যবসায়ীর ইশারায়। এ ক্ষেত্রে আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী ছিলেন তাদের সহায়ক। এক কথায় দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মাফিয়াদের হাতে। আর সুযোগ বুঝে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা নামে-বেনামে বের করে নিয়েছেন তারা। এর বড় অংশই বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন আলোচিত এই ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে নৌপথে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন সালমান এফ রহমান।
বিগত সরকারের সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা মূল্যায়ন করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘গত কয়েক বছর দেশের ব্যাংক খাতে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক তার দায় এড়াতে পারে না। বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলার জারি করে অনিয়ম-দুর্নীতির বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি চেষ্টা করত হয়তো অনেক অনিয়ম ঠেকাতে পারত। আবার অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো রাজনৈতিক প্রভাব বা হস্তক্ষেপের কারণে অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হতো। তার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অনিয়ম ঠেকাতে চেয়েছিলেন কি না—সেটা গুরুত্বপূর্ণ।’
জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর শুরু হয় ব্যাংক দখল ও লুটপাটের ধারা। আওয়ামী লীগ শাসনামলের শুরুতে ২০০৯ সালের ১ মে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. আতিউর রহমান। দায়িত্বের প্রথম মেয়াদে তেমন কোনো অভিযোগ না থাকলেও দ্বিতীয় মেয়াদে সমালোচনার মুখে পড়েন এই অর্থনীতিবিদ। বিশেষ করে গণমাধ্যমে অতিপ্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের কারণে বিতর্কিত হন তিনি। এসএমই ঋণ বিতরণের নামে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহর নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ বাদ দিয়ে তার এসব সফরে ব্যাংকগুলোকে গেট, পোস্টার, ফেস্টুন তৈরিতে বাধ্যও করেছেন তিনি। সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্ভারে ঢুকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নেয় হ্যাকাররা। ভয়াবহ ওই ঘটনা সরকারের কাছ থেকে ২৪ দিন লুকিয়ে রাখেন গভর্নর। এর জেরে ওই বছরের ১৫ মার্চ গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আতিউর রহমান দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ই এস আলম গ্রুপ নামে-বেনামে দেশের বৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তবে সে সময় ব্যাংকটি দখলে বাধা দেন গভর্নর। তার যুক্তি ছিল, এই ব্যাংক বিপদে পড়লে দেশের আর্থিক খাত পুরোটাই বিপদে পড়বে। এজন্য এস আলম গ্রুপের চক্ষুশূল হয়েছিলেন তিনি। ওই সময় সরকারে সঙ্গে আঁতাত করে নিয়োগ পাওয়া এস আলমের বিশ্বস্ত ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
গভর্নর নিয়োগে হস্তক্ষেপ ও নীতিমালা পরিবর্তন:তথ্য বলছে, আতিউর রহমান পদত্যাগ করায় ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ দেশের ১১তম গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ফজলে কবির। সালমান এফ রহমান ও সাইফুল আলমের (এস আলম) পরামর্শেই তাকে সে সময়ে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদান হিসেবে তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এস আলমকে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ অন্তত পাঁচ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নিতে সহায়তা করেন। অবশ্য নির্বিঘ্নে ব্যাংক দখল ও সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করার সুযোগ করে দিতে একের পর এক নীতি পরিবর্তন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপার ভিশন, ব্যাংকিং রেগুলেশন, বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি এবং পরিদর্শন বিভাগগুলো অন্তত অর্ধশত সার্কুলার পরিবর্তন করেছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই বিষয়ে সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন নীতিমালা করতেও দেখা গেছে। এস আলম, বেক্সিমকোসহ বড় গ্রুপগুলোকে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কারণে ২০২০ সালে সর্বসম্মতিক্রমে দ্বিতীয় মেয়াদে ফের গভর্নর হন ফজলে কবির। এক্ষেত্রে তাকে নিয়োগ দিতে গভর্নরের সর্বোচ্চ বয়সসীমায়ও পরিবর্তন আনা হয়। ২০২০ সালের ১৫ জুলাই গভর্নরের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়। ফজলে কবির তার দায়িত্ব থাকা অবস্থায় দেশের বড় গ্রুপগুলোকে সুবিধা দিতে অন্তত ৩১টি সার্কুলার দিয়েছেন। দেশের আর্থিক খাতের সুবিধার বিপরীতে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও আলোচনা রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকায় আলিশান সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পাওয়া জমিতে একটি শিল্প গ্রুপ আলিশান বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে। এ কাজের সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন ‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে একাধিকবার ফোন করা হলে প্রতিবারই তার নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি।
লুটপাটের অংশীদার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারাও:
এস আলম, সালমান এফ রহমানসহ বড় গ্রুপগুলো শুধু গভর্নরকেই কিনে নেননি। এই কাজে সহায়তার জন্য তারা নিয়োগ দিয়েছেন একের পর এক ডেপুটি গভর্নর ও নির্বাহী পরিচালক। ডেপুটি গভর্নরদের তালিকায় আছেন সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী, এস এম মনিরুজ্জামান, আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফারাহ নাসের ও খুরশিদ আলম। এদের মধ্যে এস কে সুর চৌধুরী এবং মনিরুজ্জামান এরই মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফারাহ নাসের ও খুরশিদ আলমকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন।
শুধু ডেপুটি গভর্নররাই নন, এই তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান অন্তত অর্ধশত নির্বাহী পরিচালক। ভয়াবহ লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতা আর জাতীয় নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ায় সম্প্রতি ডেপুটি গর্ভনরের খুঁজে গঠিত সার্চ কমিটির কাছে অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা হলেন নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায়, মেজবাউল হক ও আনোয়ারুল ইসলাম। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান নির্বাহী পরিচালকদের অন্তত অর্ধডজন কর্মকর্তা এস আলম ও সালমান এফ রহমানকে সহায়তা দিতে কাজ করেছেন।
পাচারের পথও ছিল উন্মুক্ত:
দেশের অর্থপাচার ঠেকানোর দায়িত্বে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাস থেকে শুরু করে অন্তত একডজন কর্মকর্তা এস আলম, সালমান এফ রহমানসহ শীর্ষ ব্যবসায়ীদের দ্বারা সুবিধাভোগী। তাদের থেকে সুবিধা দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েকশ কোটি টাকা। তাদের বিরুদ্ধে উঠেছে অর্থ পাচারে সহায়তা ও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ। এমনকি পাচার ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা সংস্থাটির কর্মকর্তারা উল্টো অর্থ পাচারে সহায়তা করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। বেক্সিমকো, নাসাসহ রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন প্রভাবশালী গ্রুপের অর্থ পাচারের সময় সম্পূর্ণ চুপ ছিল বিএফআইইউ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে দেওয়া লিখিত অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ এবং নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপের সন্দেহজনক লেনদেন কখনো তদন্ত করা হয়নি। একজন অতিরিক্ত পরিচালক এবং বিএফআইইউ প্রধান তারা নিজেরাই গ্রুপ দুটির লেনদেন দেখভাল করতেন। সে কারণে এসব কেস কেউ তদন্ত করার সাহস পেতেন না। অর্থাৎ বেক্সিমকো এবং নাসা গ্রুপের অর্থ পাচারে বিএফআইইউর নীরব সায় ছিল। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার ঠেকানো তো দূরে থাক; ন্যূনতম চেষ্টাও করেনি বিএফআইইউ। বরং দেখা গেছে উল্টো চিত্র।
অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, বিএফআইইউর তিনজন অতিরিক্ত পরিচালক, দুজন যুগ্ম পরিচালক এবং একজন উপপরিচালক বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের থেকে ঘুষের মাধ্যমে অনিয়মে সহায়তা করেছেন। সহায়তা করেছেন অর্থ পাচারেও। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভুয়া তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করে হয়রানিসহ ঘুষ দাবি করেছেন। ঘুষ না দিলে দুদকে অভিযোগ পাঠানোসহ নানাভাবে হেনস্তার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
জেএন/এমআর