২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর। অগ্রহায়ণের হালকা শীতের রাত। রাজধানীর দক্ষিণখানের হাজী মার্কেটের সামনে থেকে সাদা পোশাকের কয়েক ব্যক্তি ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয় তেজগাঁও সরকারি কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক তরিকুল ইসলাম ঝন্টুকে। ছেলে রাতে আর বাড়ি ফেরেনি। বাবা নুর মোহাম্মদ খান বুঝতে পারেননি ছেলের ভাগ্যে কী ঘটেছে। ভেবেছিলেন, সরকারবিরোধী রাজনীতি করা ছেলের নিয়তিতে জেল নির্ধারিত। কিন্তু থানা, আদালত, কারাগার কোথাও ঝন্টুর সন্ধান না পেয়ে বুঝতে পারেন, তাঁর আদরের সন্তানকে গুম করা হয়েছে।
ছেলেকে ফিরে পেতে পুলিশ, র্যাব, ডিবি কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে বছরের পর বছর ঘুরেছেন নুর মোহাম্মদ খান। তীব্র মনোকষ্ট নিয়ে তিনি ২০১৬ সালে মারা যান। আর ঝন্টুর মা হাসিনা বেগম ১১ বছর পরও রাত জেগে থাকেন ছেলের অপেক্ষায়। দরজায় শব্দ হলে ভাবেন, এই বুঝি ছেলে এলো!
ঝন্টু ফিরে এসে যদি মাকে খুঁজে না পান– এই শঙ্কায় ভাড়া বাসা বদল করেননি হাসিনা বেগম। ঝন্টুর ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম মিঠু সমকালকে বলেন, সেদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাসার সামনে লন্ড্রিতে গিয়েছিলেন তাঁর ভাই। দুটি সাদা মাইক্রোবাসে আসা ব্যক্তিরা ডিবি পরিচয়ে ঝন্টুকে গাড়িতে তোলে। ওই রাতে ঝন্টুকে তুলে নেওয়ার ঘটনা জানতে পারেননি। বাসায় না ফেরায় ভেবেছিলেন, গ্রেপ্তার এড়াতে হয়তো কারও বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। পরদিন ওই দোকানি জানান, রাতে ঝন্টুকে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। কিন্তু র্যাব, ডিবিসহ পুলিশের সব ইউনিট ঝন্টুকে আটকের কথা অস্বীকার করে। তাঁকে আদালতে তোলা হবে– এ আশায় কয়েকদিন আদালতে যান বাবা-মা। সেখানে না পেয়ে ২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর দক্ষিণখান থানায় জিডি (নম্বর ৪৩৬) করেন হাসিনা বেগম। ১৩ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেন। কিন্তু পুলিশ কখনোই সহায়তা করেনি। উল্টো হয়রানি করেছে। শুধু ঝন্টু নন, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে গুম হয়েছিলেন অন্তত ৬৭৭ জন। তাদের বাবা-মা, পরিবার-স্বজন প্রতিদিন প্রহর গোনেন কখন ফিরবে তাদের প্রিয়জন।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে, গত বছরের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন অন্তত ১৫৩ জন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর তিনজন ফিরেছেন পাঁচ থেকে আট বছর নিখোঁজ থাকার পর। এ হিসাবে গুমের শিকার অন্তত দেড়শ জন এখনও নিখোঁজ।
আগে ফেরত আসা ব্যক্তিরা মুখ না খুললেও এখন জানাচ্ছেন শেখ হাসিনার আমলে কীভাবে ভিন্নমতের মানুষ, বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতের নেতাকর্মীকে তুলে নিয়ে গোপন বন্দিশালায় মাসের পর মাস আটকে রাখা হতো।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা অপেক্ষায় আছেন এখনও। নিয়মিত কর্মসূচি পালন করে চলেছেন। এরই মধ্যে দেখা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার গুমের ঘটনা উদ্ঘাটন করে ৪৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বিচারপতি মো. মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন করেছে। গতকাল সই করেছে জাতিসংঘের গুমবিরোধী সনদে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ শুক্রবার বিশ্বজুড়ে পালিত হবে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস। এ উপলক্ষে আজ মানববন্ধন, সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে গুমের শিকার স্বজনের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’।
মোকাদ্দেসকে কোথায় রেখেছিল, এটুকুই জানতে চান বাবা
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের দুই নেতা শাহ মো. ওয়ালীউল্লাহ ও মোকাদ্দেস আলীকে ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে তুলে নিয়ে যায় র্যাবের পোশাক পরা এবং সাদা পোশাকধারী কয়েক ব্যক্তি। উচ্চ আদালতে রিটেও সন্ধান মেলেনি তাদের। আওয়ামী লীগ শাসনামলে কোণঠাসা এবং অনেকটাই নিষিদ্ধ থাকায় গুম হওয়া জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীর বিষয়টি খুব একটা আলোচনায় আসেনি।
পিরোজপুর সদরের মোকাদ্দেস পড়তেন তখন অনার্স শেষ বর্ষে। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ফাইনাল পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল। তাই ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে সহপাঠী ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে ঢাকার গাবতলী থেকে হানিফ পরিবহনের বাসে চড়েন। মোকাদ্দেসের বাবা আবদুল হালিম সমকালকে বলেছেন, গাড়ির নম্বর ছিল ৩৭৫০। বাসটি আশুলিয়ার নবীনগর পৌঁছানোর পর র্যাব গাড়ি থামার সংকেত দেয়। র্যাব সদস্যরা বাসে উঠে মোকাদ্দেস ও ওয়ালীউল্লাহকে নামিয়ে নিয়ে যান। সুপারভাইজার আমাদের পরে জানান, একজন র্যাব সদস্যের বুকের নেমপ্লেটে লেখা ছিল ‘জামান’। গাড়িতে লেখা ছিল ‘র্যাব-৪’।
আবদুল হালিম বলেন, ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে পরের ২১ দিন কুষ্টিয়া ও ঢাকায় ছেলেকে খুঁজি। এর পর আশুলিয়া থানায় জিডি করি। হাইকোর্টে রিট করি। পুলিশ, র্যাব, ডিবি, ডিজিএফআইসহ ৯টি সরকারি সংস্থাকে সাত দিনের মধ্যে মোকাদ্দেস ও ওয়ালীউল্লাহর অবস্থান জানাতে আদালত নির্দেশ দেন। কিন্তু তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে গিয়ে এ আদেশ পাল্টে ফেলেন। কারণ, শেখ হাসিনা সরাসরি জড়িত ছিলেন এসব গুমে।
আবদুল হালিম বলেন, মোকাদ্দেসের মা আয়েশা সিদ্দীকা এখনও ছেলের জন্য পথ চেয়ে রয়েছেন। হয়তো তাঁর ছেলে আর নেই। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আবদুল হালিমের আরজি– পুলিশ, ডিজিএফআই, এনএসআইসহ বিভিন্ন সংস্থার যেসব গোপন কারাগার ছিল, সেগুলো তাঁকে দেখতে দেওয়া হোক।
কেন এই আরজি– প্রশ্নে আবদুল হালিম বলেন, ‘আমি একটু দেখতে চাই, আমার ছেলেটাকে কোথায় রেখেছিল। আমার ছেলেটার সঙ্গে কী করেছিল।’
গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনে পুরোপুরি ভরসা পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন আবদুল হালিম। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আমলেও যখন আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ত, তখন বাড়িতে পুলিশ এসে খোঁজ নিত। জানতে চাইত, মোকাদ্দেসের সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল কিনা, ছেলেকে অপহরণ করতে পারে বলে কাউকে সন্দেহ করি কিনা। তারা সব জেনেও প্রশ্ন করে কষ্টটাকে আরও বাড়িয়ে তুলত। কমিশন যেন একই কাজ না করে। দীর্ঘ সময় না নিয়ে আমাদের প্রতি যেন ন্যায়বিচার করে। আমার ছেলেটার সঙ্গে আসলে কী হয়েছে, তা যেন জানায়।
সাহায্য না করে খারাপ আচরণ করেন ‘ডিবি হারুন’
২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অবরোধ চলাকালে গাজীপুর থেকে নিখোঁজ হন ঢাকার পল্লবী থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নূর আলম। গ্রেপ্তার হতে পারেন শঙ্কায় নূর আলম সপরিবারে গাজীপুরে ভাইয়ের বাসায় ছিলেন। তাঁর স্ত্রী রিনা বেগম জানান, মধ্যরাতে সাদা মাইক্রোবাসে ১০ জন পোশাকধারী পুলিশ আসে। নূর আলমের বড় ভাই নুরুল ইসলাম দরজা খুলে দেন। তখন তিনি ও তাঁর স্বামী ঘুমিয়ে ছিলেন। পুলিশ ঘরে ঢুকে নূর আলমকে বিছানা থেকে টেনে দরজার দিকে নিয়ে যেতে থাকে। কোথায় নিচ্ছেন– জিজ্ঞেস করলে জয়দেবপুর থানায় যোগাযোগ করতে বলে।
রিনা বেগম জানান, পরদিন সকালে থানা থেকে বলা হয়, নূর আলম নামে কাউকে আটক করা হয়নি। পল্লবী থানাও একই উত্তর দেয়। না পেয়ে জয়দেবপুর থানায় জিডি করেন রিনা বেগম। ১৭ ফেব্রুয়ারি মামলাও করেন। কিন্তু পুলিশ নিয়ে গেছে– এ কথা লিখতে পারেননি এজাহারে।
২০১৫ সালে গাজীপুরে এসপি ছিলেন বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশিদ। স্বামীর খোঁজে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন রিনা বেগম। কিন্তু সাহায্য না করে খারাপ আচরণ করেন হারুন। দুই বছর মামলা চলার পর পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে গুমের কথা অস্বীকার করা হয়েছে।
ব্যবস্থা না নিয়ে তাচ্ছিল্য করত সরকার
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ ২০২২ সালের আগস্টে নিখোঁজ ৭৬ তালিকা দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকারকে। মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেত ঢাকা সফরে এসে এ তালিকা নিয়ে কথা বলেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে।
তখন সরকারের তরফ থেকে গুমের অভিযোগ বরাবরের মতো অস্বীকার করা হয়। জানায়, ১০ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। বাকিদের মধ্যে ১০ জনকে খুঁজে পেতে পুলিশ সহযোগিতা করতে চাইলেও তাদের স্বজনের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বাকি ৫৬ জন ‘পলাতক’। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, এই ব্যক্তিরা মামলার ভয়ে পালিয়ে রয়েছেন। আবার কখনও বলেন, তারা অবৈধ পথে বিদেশ যেতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরেছে।
যে ১০ জনকে খুঁজে পেতে পুলিশকে সহযোগিতা করেছে বলে দাবি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার, তাদের একজন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা মোকাদ্দেস আলী। তাঁর বাবা আবদুল হালিম বলেন, অবান্তর প্রশ্ন করা ছাড়া কিছুই করেনি পুলিশ।
এখনও কত নিখোঁজ
আওয়ামী লীগ সরকারের হিসাব ধরলে, এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ৬৩ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হয়েছেন ৬৭৭ জন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে বলেন, এখনও ৭০০ মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা করা হবে।
বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক, সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হীরুসহ অর্ধশত এখনও নিখোঁজ। ছাত্রদলের ১৯ নেতাকর্মী এবং ছাত্রশিবিরের পাঁচ নেতা এখনও নিখোঁজ। জামায়াতের চার নেতাকর্মীর দু’জন ফিরেছেন। নিখোঁজ সবাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়ছে, ২০০৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬২৯ জন গুমের শিকার হয়েছেন বলেও জানিয়েছে আসক। তাদের মধ্যে লাশ উদ্ধার হয়েছে ৭৮ জনের। ছেড়ে দেওয়া হয় ৫৯ জনকে। পরবর্তী সময়ে ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাকিদের সন্ধান মেলেনি।
আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার প্রস্তুতি
অন্তর্বর্তী সরকার তদন্ত কমিশন গঠন করলেও গুমের অপরাধে শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার কথা জানিয়েছেন বিএনপি নেতা সৈয়দ সাদাত আহমেদ। ২০১৭ সালে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে চার মাস গোপন বন্দিশালায় আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়েছে তাঁর ওপর।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা এবিএন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তার ছেলে সৈয়দ সাদাত সমকালকে জানান, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এখন সরব মানবাধিকার কমিশন
শেখ হাসিনার আমলে গুম নিয়ে কিছু না বললেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সরব হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. কামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, কোনো ব্যক্তিকে জোরপূর্বক তুলে নেওয়া মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর জন্য দায়ী। শুনেছি নির্যাতনের জন্য ‘আয়নাঘর’ নামের বন্দিশালা ছিল। সেখানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী মানুষকে ধরে নিয়ে দীর্ঘদিন আটকে রাখত। কিছু লোক বের হয়ে এসেছে। নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনদের আর্তনাদ দেখেছি।
কামালউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ আমলে কমিশনের পক্ষ থেকে গুম ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সদুত্তর দিতে পারেনি।
জেএন/এমআর