জুলাই মাসে দেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে সংযুক্ত আরব আমিরাতেও বিক্ষোভ করেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশটির আইনে প্রকাশ্যে এভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন দণ্ডণীয় অপরাধ। আইন অমান্য করায় গ্রেফতারের পর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয় ৫৭ প্রবাসীর। আওয়ামী সরকার সে সময় বিষয়টি ‘সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে এড়িয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকার এসে প্রমাণ করেছে কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রবাসীদের এ অনিশ্চয়তা থেকে উদ্ধার করা যেত।
জানা যায়, দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সরকার পতনের এক দফা দাবি আন্দোলনের প্রভাব দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের বাংলাদেশ কমিউনিটিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিক্ষোভও করেন। কিন্তু আইনি ঝামেলা থাকায় আরব আমিরাতে বিক্ষোভকারী ৫৭ জন শ্রমিক ফেঁসে যান। দেশটির আইন অনুযায়ী তাদের যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এতে অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি হয় প্রবাসী শ্রমিকরা। কারাদণ্ড পাওয়া শ্রমিকদের পরিবার বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অন্তর্বর্তী সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় কারাদণ্ড পাওয়া ১৪ জন প্রবাসী দেড় মাসের মধ্যে মুক্তি পান। বর্তমানে তারা দেশে অবস্থান করছেন।
সদিচ্ছা ছিল না সাবেক সরকারের
সাবেক সরকারের প্রশাসন তখন সাজাপ্রাপ্তদের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে রাজি হয়নি। প্রশাসনের দাবি ছিল, এটি আরব আমিরাতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। গত ২৫ জুলাই প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন ‘যে দেশে বসবাস করবে সে দেশের আইন সম্পর্কে কর্মীদের সচেতন হওয়া উচিত। যারা আইন ভঙ্গ করবে, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে, তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।’
আরব আমিরাতে দণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশের নাগরিকদের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী তখন বলেন, ‘দেশটির আইন ভঙ্গ করায় তাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। এখানে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। এটি তাদের রাষ্ট্রীয় বিষয়।’
একই সুরে কথা বলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদও। তিনি বলেন, ‘বিদেশে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অনেক জায়গায় বিএনপি-জামায়াত জঙ্গিগোষ্ঠী পাকিস্তান কমিউনিটির সহায়তা নিয়েছে। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বিক্ষোভ হয়েছে, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আমিরাত যাদের গ্রেফতার করেছে সেটা ওই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। শাস্তি দেওয়াটাও তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’
অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে শ্রমিকদের ক্ষমার ব্যবস্থা করে
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সাজাপ্রাপ্তদের পরিবার মুক্তির জন্য উপদেষ্টাদের কাছে আবেদন জানায়। এরপর গত ১২ আগস্ট আইনজীবী ওলোরা আফরিনকে নিয়োগ দেয় সরকার।
এ বিষয়ে আইনজীবী ওলোরা আফরিনকে সাহায্য করে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) দূতাবাস। এর আগে ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পক্ষ থেকে (ফ্লাড) জানানো হয়, কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৫৭ জন বাংলাদেশি শ্রমিককে আইনি সহায়তা দিচ্ছে তারা।
ফ্লাডের আইন ও গবেষণা বিভাগের পরিচালক ব্যারিস্টার কাজী মারুফুল আলম জানান, এই শ্রমিকদের জন্য আইনি সহায়তা দেওয়ার সময় আমরা জানতে পারি, এসব শ্রমিকের কেউই ওই দেশের আইন সম্পর্কে জানতেন না।
এরপর গত ৩ সেপ্টেম্বর সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফেডারেল আদালতে দণ্ডিত হওয়া ৫৭ জন বাংলাদেশিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ক্ষমা করেছেন। তিনি এটাকে সরকারের কূটনৈতিক সফলতা বলেও উল্লেখ করেন।
মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করায় আটক প্রবাসী বাংলাদেশিদের ছাড়া পাওয়া কূটনৈতিক সফলতা। আমরা চাই প্রবাসীরা যেন কোনোভাবেই ভোগান্তিতে না পড়ে।’
১৯ জুলাই আরব আমিরাতে যা ঘটেছিল
গত ২৩ জুলাই বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, আসামিরা বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেশ কয়েকটি রাস্তায় জড়ো হয়ে বড় আকারের মিছিল বের করে। সেদিন দেশটির পুলিশ তাদের সতর্ক করলেও বিক্ষোভকারীরা থামেনি। এ কারণে তাদের আটক করে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
যে শাস্তি হয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের
গত ২১ জুলাই দেশটির আদালত বিক্ষোভকারী বাংলাদেশিদের সাজা ঘোষণা করেন। তিনজনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছর এবং একজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। কারাদণ্ড শেষে সবাইকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আদেশও দেন আদালত।
ক্ষমাপ্রাপ্তরা দেশে ফিরে যা বলেন
৭ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে শাহীন আহমেদ বলেন, আমি দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে দুবাইয়ে বসবাস করছি। কোটা আন্দোলনে ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি মেনে না নিয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা যে গুলি চালিয়েছিল, মৌন মিছিল করে আমরা তার প্রতিবাদ জানাই। আমরা জানতাম প্রতিবাদ করলে রাজতন্ত্র আইনে আমাদের শাস্তি পেতে হবে। সেই শাস্তিকে উপেক্ষা করেই আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম।’
কারাদণ্ড পাওয়া আরেক প্রবাসী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অনেকে ওই দেশের আইন সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলাম না। তবে যতটুকু অবগত ছিলাম, তাতে আমরা জানতাম আমাদের শাস্তি হবে। কিন্তু সেটাকে আমরা তোয়াক্কা করিনি। কারণ দেশের ঘটনাগুলো আমাদের মানসিকভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছিল। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যাই হোক, আমরা আন্দোলন করবো।’
এ বিষয়ে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বলেন, ‘আরব আমিরাতে সাজাপ্রাপ্তদের প্রতি চিফ অ্যাডভাইজরদের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তারা দেখিয়েছেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে আসলে সব সম্ভব। তবে এখানে একটি বিষয় ক্লিয়ার, প্রবাসীরা ওই দেশের আইন লঙ্ঘন করেছেন। আর আমাদের দূতাবাস তাদের আইনের বিষয়টা সমর্থন করেছে। দূতাবাসের সমর্থনের বিষয়টা ছিল সে রেজিমের দৃষ্টিভঙ্গি। তারা দেখেছে যারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে, তারা সরকারের প্রতিপক্ষ। তাই সেই জায়গা থেকে তারা প্রবাসীদের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এক্ষেত্রে তারা চুপ থাকতে পারতো।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশিরা যেহেতু প্রবাসে আছে, আমরা তাদের গাইডেন্স দিতে পারি। কিন্তু আমরা তাদের বিপক্ষে কেন দাঁড়াবো। তাই নতুন সরকার যেন প্রবাসীদের পলিসি পলিটিক্যালি ব্যবহার না করে। একপেশে সিদ্ধান্ত যেন না নেওয়া হয়। সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে।’
জেএন/এমআর