চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে চলতি মাসে এ বছরের সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যু দেখেছেন চট্টগ্রামের মানুষ। জেলায় সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৩৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। এ জেলায় গত ৮ মাসে ৫ জনের মৃত্যু ও আক্রান্ত হয়েছেন ৫৯৮ জন। সে হিসেবে চলতি মাসে রেকর্ড আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে মশাবাহিত এই রোগের বিস্তার ও মৃত্যু উদ্বেগজনক বলে মনে করছে স্বাস্থ্য বিভাগ। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে আলাদা ওয়ার্ড চালুর নির্দেশ দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন।
মশক নিধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) স্বাস্থ্য বিভাগকে চিঠি দিয়েছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। তবে নগরীতে সিটি কর্পোরেশন মশক নিধন কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
এদিকে চলতি বছর এ জেলায় জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যা ১২৩২ জন। সে হিসেবে শুধু সেপ্টেম্বরের ২৪ দিনেই পুরো বছরের অর্ধেকের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এছাড়া সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বছরের আগের ৮ মাসের মোট মৃত্যুর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
শনিবার চমেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান নোয়াখালী জেলার সেনবাগের বাসিন্দা আবুল হোসাইন (৩৭)। ১০ সেপ্টেম্বর তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।
আবুল হোসাইনসহ চলতি মাসে জেলায় ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮। তবে তাদের মধ্যে কয়েকজন কক্সবাজার, খাগড়াছড়িসহ অন্য জেলার বাসিন্দা রয়েছেন।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামে চলতি বছর ১২৩২ জন ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬৬ জন। অথচ আগস্ট মাসে আক্রান্ত ছিলেন ২০২ জন, জুলাইয়ে ১৯৮, জুনে ৪১, মে মাসে ১৭, এপ্রিল মাসে ১৮, মার্চে ২৮, ফেব্রুয়ারিতে ২৫ এবং জানুয়ারিতে ৬৯ জন।
সূত্র আরও জানায়, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ১২৩২ জনের মধ্যে ৭২১ নগরীর বাসিন্দা এবং ৫১১ জন উপজেলার বাসিন্দা রয়েছে। এরমধ্যে পুরুষ রয়েছেন ৬৬৯ জন, মহিলা ৩৩০ জন ও শিশু রয়েছেন ২৩৩ জন। এছাড়া মারা যাওয়া ১৩ জনের মধ্যে ৩ জন পুরুষ, ৮ জন মহিলা ও ২ জন শিশু রয়েছেন। চট্টগ্রামে গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১৪ হাজার ৮৭ জন। মৃত্যু হয়েছিল ১০৭ জনের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা ডেঙ্গু রোগীর আসল চিত্র নয়। কারণ, অনেকে অসুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকে রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য পেয়ে বাসা-বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েও ভালো হয়ে যাচ্ছেন। এ সংখ্যাটা আক্রান্তের মোট তালিকায় নেই।
কীটতত্ত্ববিদ ও মহামারি-বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা মৌসুমে সাধারণত ডেঙ্গু বাড়ে, পরে তা কমে আসে। তবে এখন বর্ষার যে ধরন, তাতে মৌসুমের পরে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে বেশি বৃষ্টি হয়। আবার বর্ষা-উত্তরকালে চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশে ডেঙ্গু বিস্তারের উদাহরণও আছে। তাই নিশ্চিন্ত থাকার কিছু নেই। প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আবারও বাড়তে পারে। কারণ, বর্ষার মূল মৌসুমের পরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার নজির আছে। ঝুঁকিতে ৬১ শতাংশ এলাকা।
সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. সরফুল ইসলাম বলেন, ‘সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রতিদিন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও ঠিকানা সিটি করপোরেশনের কাছে সরবরাহ করা হয়। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিশ্লেষণ এবং ঠিকানা যাচাই করে ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বায়েজিদ বোস্তামী, বাকলিয়া ও আন্দরকিল্লা থানা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। নগরের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এগুলো অনেক বেশি ঘনবসতি। আর এখানে এডিস লার্ভার ঘনত্বও বেশি। তাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। এসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমাতে এক দিন পরপর ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। এ নিয়ে আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুত রয়েছে। মশক নিধনের জন্য সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সরকারি হাসপাতালগুলোতে পৃথক ডেঙ্গু কর্নার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জমে থাকা পানি ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র। জমে থাকা পানি নিয়ে সবার সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। যেমন, প্লাস্টিকের খোসা, টায়ার, ফুলের টবেও পানি জমে থাকে। এসব বিষয়ে নজর রাখলে রোগীর সংখ্যা কমে আসবে।’
জেএন/এমআর