ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তৃতীয় দফায় সংলাপ করেছেন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। সংলাপে সংস্কার ও আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের রোডম্যাপের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবে জামায়াতসহ কেউ কেউ নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর নেতারা জানিয়েছেন নানা মত।
শনিবার (৫ অক্টোবর) বেলা আড়াইটায় বিএনপি দিয়ে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত চলে সংলাপ। এদিন আটটি দল সংলাপে অংশ নেয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এই সংলাপে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির পর ধাপে ধাপে জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক জোট, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (দুই অংশ) সংলাপে অংশ নেয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। আগে আরও দুই বার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছে এই সরকার। এবার সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে হাত দিতে যাচ্ছে, এর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিতেই তৃতীয় দফার এই সংলাপের আয়োজন করা হয়।
সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ জানতে চাওয়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দাবি পেশ করা হয়েছে।
ফখরুল জানান, নির্বাচন করা অন্তর্বর্তী সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার, এটি প্রধান উপদেষ্টা তাদের জানিয়েছেন।
প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের অনেক দোসর কর্মরত আছেন জানিয়ে তাদের অপসারণ, জেলা প্রশাসক নিয়োগে নতুন ফিট লিস্ট এবং যেসব জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের নিয়োগ বাতিল, ফ্যাসিবাদের সময়ের চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দু-একজন আছেন যারা বিপ্লব-গণঅভ্যুত্থানের যে মূল স্পিরিট তাকে ব্যাহত করছে, তাদের সরানোর কথা বলেছি। আমরা গত ১৫ বছর ধরে সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বঞ্চিতদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি নিশ্চিত করার জন্য বলে এসেছি।
ফখরুল বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। আমরা একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। নির্বাচন কমিশন কবে নির্বাচন করবে সে ব্যাপারে একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, আমরা এনআইডি কার্ড যেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করতে আইন করা হয়েছিল সেটাকে অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে বাতিল করতে বলেছি।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে রোডম্যাপ চেয়েছে জামায়াতে ইসলামীও। সংস্কার সফল হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে বলে মনে করে দলটি। এজন্য নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারে গুরুত্বারোপ করেছে জামায়াত।
সংলাপ শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আগামী ৯ অক্টোবর আপনাদের মাধ্যমে আমাদের প্রস্তাবনাগুলো আমরা জাতির সামনে উন্মুক্ত করব। আমরা আমাদের চিন্তা জাতির সামনে তুলে ধরব কী কী সংস্কার এই মুহূর্তে প্রয়োজন, কী কী সংস্কার পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের লাগবে।’
জামায়াত সংস্কারকে এক নম্বরে গুরুত্ব দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সংস্কারের টাইমলাইন কী হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা দুইটা বিষয় দেশবাসীর কাছে চেয়েছি এবং সরকারের কাছে জানিয়েছি। একটা রোডম্যাপ হবে সংস্কারের, আরেকটা নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলে নির্বাচন সফল হবে। দুইটা বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি।’
গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়ার কথা প্রধান উপদেষ্টার কাছে বলেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। মঞ্চের সমন্বয়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সংস্কারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়। আমরা স্পষ্ট করে আমাদের মতামত দিয়েছি। আমরা বলেছি, সংস্কার আমাদের…. আমরা একটা সরকার বদলানোর আন্দোলন করছি না, নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি না, সামগ্রিকভাবে আন্দোলন করছি, যাতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়ায় একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করা যায়। আবার যাতে ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে, সে কারণে সংস্কার আগে প্রয়োজন।
তবে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেই নির্বাচনের পথে যেতে হবে উল্লেখ করে মান্না বলেন, আমরা বলেছি, যতদূর পর্যন্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সংস্কার করতে পারবো, ততদূর পর্যন্ত আমরা সংস্কার করব। বাকি যেসব সংস্কার দরকার, তা পরের নির্বাচিত সরকার এসে করবে।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের বিষয়টি বিবেচনায় রাখার কথা বলেছেন বলে জানান মান্না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের বাজারে ঊর্ধ্বগতির ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছি। পুরনো সিন্ডিকেট আবার যে নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছি। তারা বলেছেন, চারটা কাজকে অগ্রাধিকার মধ্যে নিয়েছেন। সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে। আমরা দেখতে চাই, মানুষ যেন এর সুফল পায়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য যাতে বন্ধ হয়।’
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত ৬টি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আরও ৯টি সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব পেশ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
দলটির আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাইর নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।
সংলাপে দলের আমির প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, বর্তমান সরকার জনমতের প্রতিফলনের সরকার। আপনাদের সাথে দেশের জনগণ রয়েছে, আপনারা সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার। কিন্তু খুনি, অর্থ পাচারকারী, দাগি, অপরাধীরা কীভাবে দেশ থেকে পালালো? আপনারা কেন তাদের দেশত্যাগের সুযোগ করে দিয়েছেন। এটা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে।
চরমোনাই পীর বলেন, সংস্কার কাজ শেষ করে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বৈরাচারীরা যেন কোনোভাবে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে না পারে তার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে নির্বাচন দিতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ৬ দফা পর্যবেক্ষণ ও ১১ দফা প্রস্তাবনা পেশ করেছে এবি পার্টি। এ সময় দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান করে দলটি।
এ সময় এবি পার্টির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার নিকট ৬ দফা পর্যবেক্ষণ ও ১১ দফা দাবি, পরামর্শ ও প্রস্তাবনা তুলে ধরেন দলের সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু।
সংলাপ শেষে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক বলেন, পতিত স্বৈরাচারের দোসররা যেন কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় সংস্কার কমিটিতে যুক্ত হতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আলোচিত এই হেফাজত নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে আমরা জানতে পেরেছি সংস্কারের জন্য কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনগুলো সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করবে। আলোচনার ভিত্তিতে তারা সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করা হবে। তারপর প্রস্তাবনাগুলো চূড়ান্ত সংস্কার করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে গণঅধিকার পরিষদের নেতারা ১২টি প্রস্তাব দিয়েছেন। যার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের পরিকল্পনা ও রোডম্যাপ প্রকাশ করা; যেহেতু সংবিধান ও রাষ্ট্র সংস্কার অভ্যুত্থানের একটি মৌলিক ধারণা ও এই সময়ের অপরিহার্য বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই গণহত্যায় জড়িত পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসরদের বিচার এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়াও উপদেষ্টা পরিষদের পরিসর বাড়ানো, দলবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
জেএন/এমআর