সারাদেশের মতো এই আসনটিতেও নৌকা-ধানের শীষের ‘মহারণের’ অপেক্ষায় ছিল সবাই। তফসিলের আগ পর্যন্ত সব ‘ঠিকঠাকই’ চলছিল। কিন্তু প্রার্থীরা প্রচারণায় নামতেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চার দলের চারজন হেভিওয়েট প্রার্থী। সমর্থকদের দাবি, এদের কেউ কারও চেয়ে কোন অংশে কম নন! সুতরাং পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে কোমর বেঁধে নেমেছেন চার প্রার্থীর অনুসারীরাই। তারপরের গল্পটা সুস্থ নির্বাচনের জন্য কোনভাবেই প্রত্যাশিত নয়। চার প্রার্থীর প্রচারণাতেই হয়েছে হামলা, সংঘর্ষ-ভাঙচুরের ঘটনা। এসব হামলায় হতাহত হয়েছেন শতাধিক। পোস্টার-ব্যানার কেড়ে নেওয়া, হুমকী, পাল্টাপাল্টি দোষারোপ, একের পর এক সংবাদ সম্মেলন- এ ক’দিনে কী হয়নি বাঁশখালীতে! ৩০ ডিসেম্বর সারাদিন তাই কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে সাগর-পাহাড় ঘেরা অনুপম সৌন্দর্যের জনপদ বাঁশখালী।
চার হেভিওয়েটের লড়াই
বাঁশখালীতে এবারের নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মহাজোটের প্রার্থী, আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান (নৌকা), ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী, বিএনপির সাবেক সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী (ধানের শীষ), জাতীয় পার্টির প্রার্থী, সাবেক সাংসদ ও মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী (লাঙল) ও জামায়াতের প্রার্থী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা মো. জহিরুল ইসলামের (আপেল) মধ্যে।
হামলা-ভাঙচুর, সংঘর্ষ
নির্বাচনি প্রচারণাকালে চার প্রার্থীর প্রচারণাতেই বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংঘর্ষ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন, বিবৃতি ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রার্থীরা প্রত্যেকেই অভিযোগের আঙুল তোলেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে। পোস্টার-ব্যানার কেড়ে নেওয়া, মাইকিংয়ে বাধা দেওয়া, প্রশাসনের অসহযোগিতা, বিভিন্ন স্থানে কর্মী সমর্থকদের ওপর হামলা, গুলিবর্ষণ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন থেকে শুরু করে আর্থিকভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ পর্যন্ত তোলা হয়েছে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে। একই সঙ্গে চাম্বল, বৈলছড়ি, সরল, পুকুরিয়াসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে হওয়া এসব সংঘর্ষে অন্তত শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন বলে অভিযোগ করেন তারা।
তিন প্রার্থীর সংবাদ সম্মেলন
২০ ডিসেম্বর (শুক্রবার) বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির প্রার্থী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি গণসংযোগকালে দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ তোলেন।
২২ ডিসেম্বর (শনিবার) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন লাঙলের প্রার্থী জাতীয় পার্টি নেতা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। এসময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছাড়াও মহাজোট থেকে নিজের পক্ষে সমর্থন চেয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুরোধ রাখেন তিনি।
একই দিন (২২ ডিসেম্বর) বাঁশখালীর শেখেরখীল ইউনিয়নে সংবাদ সম্মেলন করেন জামায়াতের প্রার্থী মো. জহিরুল ইসলাম। তিনিও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে হামলা-ভাঙচুরের অভিযোগ তোলেন। পাশাপাশি অবাধ, নিরাপদ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তিনি প্রশাসন ও সাংবাদিকসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
আলোচনায় মাহমুদুল
নির্বাচনের প্রাথমিক হিসাব-নিকাশে জাতীয় পার্টির মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী সেভাবে প্রচারের আলোয় না এলেও প্রচারণা শুরু হতেই সবাইকে চমকে দেন প্রবীণ এই রাজনীতিক। তাঁর পক্ষে মাঠের প্রচারণায় জনসম্পৃক্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। আবার অনলাইনে তাঁর কর্মীবাহিনীর সরব উপস্থিতিও নজর কেড়েছে। পাশাপাশি একাধিকবার হামলার শিকার হওয়া, সংবাদ সম্মেলন, ফেসবুক লাইভসহ নানা কারণে প্রচারণার পুরো সময়টাতেই তিনি বেশ ভালোভাবেই নজর কেড়েছেন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) প্রচারের শেষ দিনে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে গণসংযোগে নেমে দেশজুড়ে আলোচনায় উঠে আসেন মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী।
প্রস্তুত প্রশাসন, পুলিশ-বিজিবি-সেনাবাহিনী
নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে যেতে শঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। উপজেলায় মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ-বিজিবিসহ পর্যাপ্তসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। একই সঙ্গে কোনো ধরনের সহিংসতা বা নাশকতামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা কঠোর হাতে মোকাবেলা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে।
সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোমেনা আক্তার জয়নিউজকে বলেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণের লক্ষ্যে বাঁশখালীতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে প্রশাসন। উপজেলায় পুলিশ, বিজিবিসহ পর্যাপ্তসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল হোসেন জয়নিউজকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। ভোটাররা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ভোটের দিন কোন ধরনের নাশকতা বা অপ্রীতিকর ঘটনার আশংকা করছেন কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আশা করি তেমন কিছু ঘটবে না। যদি কেউ নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে তাহলে তা শক্তহাতে মোকাবেলা করা হবে।
নির্বাচনের মাঠে আরো ৫ প্রার্থী
চার হেভিওয়েট প্রার্থীর দাপটে আলোচনার বাইরেই রয়ে গেছেন এই আসনের আরো ৫ প্রার্থী। তারা হলেন- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (হাতপাখা) এইচ এম ফরিদ আহম্মদ, বাংলাদেশ ন্যাপের (কুঁড়েঘর) আশীষ কুমার শীল, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের (মোমবাতি) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের (চেয়ার) মোহাম্মদ মহিউল আলম চৌধুরী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী (বেঞ্চ) বজল আহমদ।
ভোটের হিসাবনিকাশ
বাঁশখালীতে মোট ভোটার সংখ্যা তিন লাখ তিন হাজার ১২৩ জন। এদের মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৫৮ হাজার ৪৩৭ জন এবং নারী এক লাখ ৪৪ হাজার ৬৮৬ জন। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানকার ১১০টি ভোট কেন্দ্রের ৫৯০টি ভোট কক্ষে ভোটগ্রহণ করা হবে।