কার্তিকের গরমের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। ২৪ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের মাত্রা ওঠানামা করছে। চট্টগ্রামে সরকারি ৫টি ও বেসরকারি ১৯টি মিলিয়ে মোট ২৪টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। সরকারি কেন্দ্রগুলোতে ১২৩৭ মেগাওয়াট ও বেসরকারি ১৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৩৮৩৮ মেগাওয়াট মিলিয়ে চট্টগ্রামের সর্বমোট ৫০৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। তবে সব কেন্দ্রে প্রত্যাশিত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। চট্টগ্রামের চাহিদা মত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিড থেকেও মিলছে না। এমন পরিস্থিতিতে লোডশেডিং যেন চট্টগ্রামের নিয়তি হয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রামের আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাত। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।
হঠাৎ করে কেন এই লোডশেডিং– এর কারণ জানতে গিয়ে মোটা দাগে দুটি বিষয় সামনে এসেছে। প্রথমটি হলো, বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি (গ্যাস–কয়লা ও ফার্নেস অয়েল) সংকট। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কার্তিকের তীব্র গরমে কুলিং লোড বেড়ে যাওয়া। প্রতি বছর গ্রীষ্মের পর শরৎ ও হেমন্তের এই সময়ে অর্থাৎ কার্তিক মাসে তাপমাত্রা কিছুটা বেড়ে যায়, যা সামাল দিতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হয়। এবার কার্তিকের এই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এই ব্যাপারে পিডিবি চট্টগ্রাম আঞ্চলের সার্কেল (পূর্ব) এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম মৃধা বলেন, চট্টগ্রাম রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২১০ মেগাওয়াটের দুটি কেন্দ্র এবং মাতারবাড়ি ৬০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫ নম্বর ইউনিট, ১০০ মেগাওয়াটের এনার্জি প্যাক, শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রিজেন্ট পাওয়ার এবং ৫০ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড পাওয়ার প্লান্টটিও বন্ধ রয়েছে।
পিডিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম মৃধা বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় ১৫৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। সন্ধ্যা ৭টায় লোডশেডিং ছিল ৫৩ মেগাওয়াট। আজকে দুপুর ১১টায় চট্টগ্রামে জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ ছিল ১১১৩ মেগাওয়াট। ২টায় সরবরাহ কমে যায়। তখন জাতীয় গ্রিড থেকে বরাদ্দ দেয়া হয় ৯০০ মেগাওয়াট। তখন কিছুটা লোডশেডিং ছিল। রাত সাড়ে ৯টায় চট্টগ্রামে সরবরাহ ১৫৮৯ মেগাওয়াট ছিল বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রামের দৈনিক গড় বিদ্যুৎ চাহিদা ১২০০ থেকে ১২৫০ মেগাওয়াট। তবে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ বিতরণ করা হচ্ছে দৈনিক গড়ে ৯০০ মেগাওয়াটের মত।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চল বিতরণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১১৯০ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিড থেকে ওইদিন বিদ্যুৎ বিতরণ করা হয় মাত্র ৮৫০ ওয়াট। এমন অবস্থায় বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে দিনভর লোডশেডিং বিরাজ করেছে।
৩০ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১১৮৯ মেগাওয়াট। চট্টগ্রামের উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে ১৬৩৭ মেগাওয়াট। কিন্তু জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে ১০৪২ মেগাওয়াট। গত ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ১০৮৯ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ হয়েছে ৯৪৯ মেগাওয়াট। অথচ চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৬৩৪ মেগাওয়াট।
২৬ অক্টোবর চট্টগ্রামে ১৬৮৪ মেগাওয়াট উৎপাদিত হয়। তবে ওইদিন চট্টগ্রামের ১০৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে গ্রিড থেকে তা-ই সরবরাহ করা হয়েছে। ২৫ অক্টোবরও চাহিদা অনুপাতে বিদ্যুৎ পায় চট্টগ্রাম। অবশ্য ঐদিন চট্টগ্রামে উৎপাদন হয়েছে ১৫৭৫ মেগাওয়াট।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির মজুমদার বলেন, চাহিদার তুলনায় সারাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে করে জাতীয় গ্রিডকে ব্যালেন্স করে দেশব্যাপী সরবরাহ করতে হচ্ছে। তাই চট্টগ্রামে বিদ্যুধ বেশি উৎপাদন হলেও তা অন্য অঞ্চলেও সরবরাহ করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জাতীয় গ্রিডকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে উৎপাদন কেন্দ্র বেশি থাকলেও অনেক কেন্দ্রে বর্তমানে উৎপাদন নেই। এসব কেন্দ্রগুলো নিয়ে যাচাই-বাছাই শেষে করণীয় নির্ধারণে কাজ করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে চট্টগ্রামে ১৯টি বেসরকারি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। আর এ কাজটি করেছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমদ কায়কাউসসহ বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট বিশেষ আইনে, বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও আওয়ামী সমর্থক ব্যবসায়ীদের রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুবিধা দেয়।
লাইসেন্সে তিন বছর মেয়াদ থাকলেও মালিকরা কেন্দ্রগুলো ১০-১২ বছর পর্যন্ত সক্রিয় রেখেছিল। এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জও নির্ধারণ করা হয়েছিল উচ্চ হারে। চট্টগ্রামের শিকলবাহা ৫৫ মেগাওয়াট এইচএফও পাওয়ার প্ল্যান্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৮৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছিল। আর ক্যাপাসিটি চার্জের বাবদে প্রাপ্ত এই টাকা মালিকেরা বিদেশে পাচার করেছে।
গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, ২০০৯ সালের পর থেকে সরকার ৮২টি বেসরকারি এবং ৩২টি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এক লাখ চার হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিশোধ করেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকবর হোসেন জানান, শুষ্ক মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন তুলনামূলক কম হওয়াতে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না জাতীয় গ্রিড। সেই কারণে চট্টগ্রামে সরবরাহ কম।
গতকাল চট্টগ্রামে দিনের বেলায় বিশেষ করে দুপুর ২টা থেকে লোডশেডিংয়ের মাত্রা সীমাহীন বেড়ে যায়। এই লোডশেডিংয়ের মাত্রা বিকালেও ছিল। সন্ধ্যায়ও নগরীর বেশি কিছু এলাকায় লোডশেডিং ছিল।
এদিকে, লোডশেডিংয়ে কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের জনজীবন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানির খুব সামান্য অংশ হলো গ্যাস। চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানাসহ সকল শিল্পকারখানায় এবং আবাসিকের গ্যাসটা আসে এলএনজি থেকে। এছাড়াও তরল জ্বালানি (ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল) এবং কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে চট্টগ্রাম ও কঙবাজারের মাতারবাড়িতে। কঙবাজার মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৬০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে কয়লা সংকটের কারণে।
এ ব্যাপারে ইউনিটি স্টাইল অন্ড এক্সোসরিজ লিমিটেড এর চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক অহিদ সিরাজ চৌধুরী স্বপন বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদেরকে বিকল্প জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে। আমাদেরকে অনটাইম উৎপাদন ঠিক রাখতে হয়। তা নাহলে শিপমেন্ট করা যাবে না।
জেএন/এমআর