প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনায় আমেরিকা। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস, না রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প? কে যাবেন সাদা বাড়িতে, সেদিকেই নজর পুরো বিশ্বের। দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় থাকা সেই নির্বাচনে আজ চূড়ান্ত রায় দেবেন মার্কিনীরা। যদিও গত অক্টোবর থেকেই শুরু হয়েছে আগাম ভোটদান। রোববার পর্যন্ত সাড়ে ৭ কোটি ভোট পড়েছে। বাংলাদেশ সময় আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ আমেরিকায় ভোট গ্রহণ শুরু হবে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় একে অপরকে পিছনে ফেলছেন ৬০ বছর বয়সী কমলা ও ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প। তবে তাদের দুই জনেরই ভাগ্য নির্ধারণ হবে সাতটি অনিশ্চিত বা দোদুল্যমান রাজ্যের ফলাফলের ভিত্তিতে। পাশাপাশি আজ ভোট গ্রহণ হবে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের ৩৪ আসনে এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সব কটিতে।
উত্তেজনাপূর্ণ এই নির্বাচনে জায়গা করে নিয়েছে বাংলা ভাষাও। এদিকে এবারের নির্বাচন নানা দিক থেকেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ইউক্রেন থেকে গাজা ও লেবাননের যুদ্ধ পরিস্থিতি, চীন, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বিশ্বের সামরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণসহ একাধিক বিষয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নির্ভর করবে এই নির্বাচনের ফলাফলে। দেশটিতে ২৪ কোটি ৪০ লাখ নাগরিক ভোটদানের যোগ্য, নিবন্ধিত ভোটার ১৬ কোটির মতো। ইলেকটোরাল কলেজের মোট ভোটার সংখ্যা ৫৩৮। মেইন এবং নেব্রাস্কা এই দুটি রাজ্য বাদে বাকি সবগুলোর ইলেকটোরাল ভোট যোগ করলে যে প্রার্থী ২৭০টি পাবেন তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সেই প্রার্থীর রানিংমেট হয়ে যাবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। কমলার রানিংমেট টিম ওয়ালজ এবং ট্রাম্পের রানিংমেট জেডি ভ্যান্স।
আছেন আরও চার প্রার্থী
কমলা ও ট্রাম্প ছাড়াও আরও চার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দেবেন ভোটাররা। তারা হলেন গ্রিন পার্টির জিল স্টেইন, গ্রিন পার্টি থেকে জিল স্টেইন ছাড়াও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন কর্নেল ওয়েস্ট। লিবার্টারিয়ান পার্টি চেজ অলিভার। এছাড়া আছেন রবার্ট কেনেডি জুনিয়র। তার পক্ষে এবারের নির্বাচনে ৫-৭ শতাংশ সমর্থন ছিল। কিন্তু গত আগস্টে তিনি ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। তবে কয়েকটি অঙ্গরাজ্য তার নাম ব্যালট থেকে সরাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
ভোটদানের পদ্ধতি
যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যেই ভোটের নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তা পরস্পরের থেকে আলাদা। মোটের ওপর ভোটাররা তিনটি প্রাথমিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। প্রথমত, হ্যান্ডমার্ক করা কাগজের ব্যালট :সবচেয়ে প্রচলিত এবং সহজ পদ্ধতিতে প্রায় ৭০ শতাংশ কাগজের ব্যালট ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ হয়। দ্বিতীয়ত, ব্যালট মার্কিং ডিভাইস (বিএমডি) :২৫ শতাংশেরও বেশি ভোটার ব্যবহার করেন এই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ভোটদান পদ্ধতি। ভোটারদের একটি স্ক্রিনে বিকল্প নির্বাচন করতে দেয় এবং তারপর তাদের পছন্দ নিশ্চিত করতে একটি কাগজের ব্যালট প্রিন্ট করা হয় এই ব্যবস্থায়। ‘হেল্প আমেরিকা ভোট অ্যাক্ট’ মেনে চালু করা এই পদ্ধতিতে বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ পদ্ধতিও রয়েছে। তৃতীয়ত, ডাইরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক (ডিআরই) :এই পদ্ধতি অনেকটা ইভিএমের মতো। কাগজ ছাড়া ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায় জনতার রায় দেওয়া হয়। লুইজিয়ানা এবং নেভাদায় চালু হওয়া পদ্ধতিতে মোটের ওপর ৫ শতাংশ ভোটার আস্থাশীল।
ভোট গণনা হয় যেভাবে
কাগজের ব্যালট এবং বিএমডিতে দেওয়া ভোটগুলো সাধারণত ‘অপটিক্যাল স্ক্যানার’ ব্যবহার করে স্ক্যান করা হয়। এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফলাফল নথিভুক্ত করা যায়। এই প্রক্রিয়াটি একটি প্রাদেশিক স্তরের নির্বাচন কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করেন। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণনার পাশাপাশি প্রয়োজনে হাতে ভোট গণনারও ব্যবস্থা আছে। এছাড়া আগাম ভোটের ক্ষেত্রে চালু ‘মেইল ইন ব্যালট’ ব্যবস্থায় দেওয়া ভোটের বৈধতা যাচাই এবং গণনার প্রক্রিয়াও রয়েছে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে। অঙ্গরাজ্যের নির্বাচন কর্তৃপক্ষকে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে ফলাফল ফেডারেল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করতে হয়।
সবার নজর দোদুল্যমান রাজ্যের দিকে
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে সব কটি অঙ্গরাজ্যকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়—রেড স্টেটস (রিপাবলিকান) ব্লু স্টেটস (ডেমোক্র্যাটস) ও সুইং স্টেটস (দোদুল্যমান রাজ্য)। ১৯৮০ সাল থেকে রেড স্টেটসগুলোতে জয়ী হচ্ছেন রিপাবলিকান প্রার্থী। ১৯৯২ থেকে ব্লু স্টেটসগুলো ডেমোক্র্যাটদের দখলে। অন্যদিকে সাতটি দোদুল্যমান রাজ্য হচ্ছে—অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, নর্থ ক্যারোলিনা, পেনসিলভেনিয়া এবং উইসকনসিন। রেড ও ব্লু স্টেটগুলোর ফলাফল আগে অনুমান করা গেলেও স্বাভাবিকভাবেই এ রাজ্যেগুলোতে সম্ভব হয় না। যে কোনো সময় সব সমীক্ষা উলটে দিতে পারে এ সাত অঙ্গরাজ্য। ইতিহাস বলছে, এগুলো খুব কম ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।
নির্বাচনের নিয়ম অনুসারে, গত অক্টোবর মাস থেকেই ৪৭টি রাজ্যে ভোটগ্রহণের সূচনা হয়েছে। আজকের ভোটে সবার নজর দোদুল্যমান রাজ্যের ফলাফলে। এসব রাজ্যে সর্বশেষ দুদিন ধরে সমীক্ষা করেছে বিভিন্ন সংস্থা। রিপোর্টে দেখা যায়, দেশ জুড়ে জনমত জরিপে কমলা সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও দোদুল্যমান রাজ্যে ট্রাম্পের পাল্লা ভারী। ৪৯ শতাংশ ভোটের মধ্যে ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে রিপাবলিকানরা এগিয়ে মাত্র ১.৮ শতাংশের ব্যবধানে। অ্যারিজোনায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশের ব্যবধানে কমলার চেয়ে এগিয়ে ট্রাম্প। নেভাদায় রিপাবলিকান নেতার পক্ষে পড়েছে ৫১.৪ শতাংশ ভোট। কমলাকে পছন্দ করেছেন ৪৫.১ শতাংশ ভোটার। নর্থ ক্যারোলিনায় কমলাকে পেছনে ফেলেছেন ট্রাম্প।
বাংলা ভাষায়ও ব্যালট আছে
২০১৩ সালে প্রথম বার বাংলা ভাষায় ব্যালট ছাপা হয় মার্কিন নির্বাচনে। তবে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে নয়, নির্দিষ্ট ৬০টি নির্বাচনি কেন্দ্রের ব্যালটে বাংলা ভাষা ছাপা হয় বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু জানিয়েছে। কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই নিউ ইয়র্কে। উল্লেখ্য, আমেরিকায় বসবাস করেন লক্ষাধিক বাঙালি। তাদের মধ্যে রয়েছেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকরাও। বেশির ভাগ বাঙালিই নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। ব্রুকলিন, কুইন্স এবং ব্রঙ্কস—এ তিন এলাকায় মূলত বসবাস করেন বাঙালিরা।
শেষ সময়ের প্রচারে কমলা-ট্রাম্প যা বললেন
ইস্ট কোস্টের তিনটি দোদুল্যমান রাজ্যে (পেনসিলভেনিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা ও জর্জিয়া) রবিবার ট্রাম্প প্রচার চালান। হ্যারিস ব্যস্ত ছিলেন মিশিগানে। কমলা বলেছেন, ‘ঈশ্বর আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন, তাকে বাস্তবে রূপায়ন করতে গেলে আমাদের কাজ করে দেখাতে হবে। আমরা যেন সেই পরিকল্পনামতো কাজ করি। গণতন্ত্রের জন্য, আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য কাজ করি।’ ডেমোক্র্যাটদের দানবের সঙ্গে তুলনা করেছেন ট্রাম্প। হ্যারিস বলেছেন, ‘ঈশ্বরের পরিকল্পনায় এ বিভাজন রোধ করার যথেষ্ট শক্তি রয়েছে।’ তিনি বলেছেন, ‘মঙ্গলবার যে নির্বাচন হবে, তাতে বিশৃঙ্খলা, ভয় ও ঘৃণাকে রোধ করার একটা সুযোগ আছে।’ হ্যারিস সামাজিকমাধ্যমে জানিয়েছেন, তিনি মেইল ইন বা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন। তার সেই ব্যালট এখন ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে যাচ্ছে। পেনসিলভেনিয়ায় ট্রাম্প বলেছেন, তিনি একটি ডেমোক্রেটিক পার্টি নামক একটি দুর্নীতিগ্রস্ত মেশিনের বিরুদ্ধে লড়ছেন। যদি নির্বাচিত হতে পারেন, তাহলে তিনি পুরো ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবেন। ট্রাম্প বলেন, নির্বাচিত হলে তিনি দেশকে নতুন স্বর্ণযুগে নিয়ে যাবেন। আবারও তার অভিযোগ, গত বার ওরা চুরি করে নির্বাচনে জিতেছিল।
জেএন/এমআর