যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ভোটের দিন আজ। নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা বিরাজ করছে দেশটিতে।
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস, না রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প? কে যাবেন হোয়াইট হাউজে, সেদিকেই দৃষ্টি পুরো বিশ্বের। দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় থাকা সেই নির্বাচনে আজ মঙ্গলবার চূড়ান্ত রায় দেবেন মার্কিনিরা।
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নাকি রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হবেন হোয়াইট হাউজের পরবর্তী চার বছরের বাসিন্দা ভোটাররা সেটি নির্ধারণ করবেন এদিন।
ঐতিহাসিক নিয়ম মেনেই স্থানীয় সময় আজ মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে শুরু হবে ভোটগ্রহণ, চলবে রাত ১০টা পর্যন্ত।
দেশটির ২৪ কোটি ৪০ লাখ ভোটারের মধ্যে অবশ্য ইতিমধ্যে সাত কোটির বেশি ভোটার আগাম ভোট দিয়েছেন।
সাধারণত, যেসব রাজ্যের ভোট দ্রুত গণনা হয়, সেসব রাজ্যের ফল আগে পাওয়া যায়। তবে আগাম ও ডাকযোগের ভোট গণনার বিলম্ব হলে চূড়ান্ত ফল পেতে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
আজ প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পাশাপাশি ৩৪ জন সিনেটর এবং কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সবাইকে বেছে নেবেন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা।
দেশটিতে সাধারণত সরাসরি সাধারণ ভোটারদের (পপুলার ভোটে) নয় বরং ৫৩৮ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে যুক্তরাষ্ট্রে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। জয়ের জন্য অন্তত ২৭০টি ভোট পেতে হয়। দেশটির ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একেকটিতে ইলেকটোরাল ভোট একেক রকম।
প্রতিটি অঙ্গরাজ্য কতটি কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট রয়েছে, তার ভিত্তিতে কতজন ইলেকটোরাল কলেজ হবেন, তা নির্ধারিত হয়। সঙ্গে প্রতিটি রাজ্যে থাকা দুজন সিনেটর ইলেকটোরাল কলেজ হন।
কোন অঙ্গরাজ্যে কতটি ডিস্ট্রিক্ট থাকবে, তা নির্ধারিত হয় সেখানে মোট জনসংখ্যার আকারের ভিত্তিতে। যেমন প্রত্যন্ত ভারমন্ট অঙ্গরাজ্যে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট মাত্র তিনটি। আর সবচেয়ে বেশি ৫৪টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ক্যালিফোর্নিয়ায়।
এবার ভোটে ট্রাম্প ও কমলা ছাড়াও আছেন আরও চার প্রার্থী। তাদের মধ্যে গ্রিন পার্টির প্রার্থী ৭৪ বছর বয়সী জিল স্টেইন এর আগে ২০১২ ও ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েছিলেন। ওই সময় তিনি দশমিক ৪ শতাংশ ও ১ শতাংশ করে ভোট পেয়েছিলেন।
এ ছাড়া প্রার্থী হয়েছেন লিবার্টারিয়ান পার্টির চেজ অলিভার, যিনি ২০২০ সালের নির্বাচনে ১ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পেয়েছিলেন। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের প্রায় সবকটিই লড়ছেন দলটির প্রার্থী চেজ অলিভার। তাকে এবারের নির্বাচনের সম্ভাব্য অঘটন সৃষ্টিকারী ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
আরেক আলোচিত প্রার্থী হচ্ছেন রবার্ট জুনিয়র কেনেডি। তার পক্ষে এবারের নির্বাচনে ৫-৭ শতাংশ সমর্থন ছিল। কিন্তু গত আগস্ট মাসে তিনি ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তবে কয়েকটি অঙ্গরাজ্য তার নাম ব্যালট থেকে সরাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
আরেক প্রার্থী হচ্ছেন কর্নেল ওয়েস্ট। গ্রিন পার্টি থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন তিনি। বর্ণবাদবিরোধী ৭১ বছর বয়সী এ শিক্ষাবিদ বাইডেনকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ ও ট্রাম্পকে ‘নব্য ফ্যাসিস্ট’ বলে মনে করেন। তিনি ১২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে লড়ছেন। তার সমর্থন অল্প হলেও ডেমোক্র্যাট শিবিরের জন্য তিনি বড় দুশ্চিন্তার নাম।
যুক্তরাষ্ট্রের ভোটে লড়াইয়ের ময়দান উন্মুক্ত থাকলেও সাধারণত প্রাইমারি ও ককাসের মাধ্যমে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। এ দুই পদ্ধতির মাধ্যমে দলগুলো তাদের প্রার্থী বাছাই করে। নির্বাচনী বছরের বসন্তের শুরুর দিকে অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
স্বাধীনভাবে কেউ প্রার্থী না হলে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের অধীনে তাকে নিজ অঙ্গরাজ্যে নিবন্ধন করতে হয়। প্রাইমারিতে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে দলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ককাস প্রক্রিয়াটি আরও জটিল।
এজন্য অঙ্গরাজ্যগুলোতে রাজনৈতিক দলের সদস্যরা একত্র হন। সেখানে তারা ভোটাভুটির মাধ্যমে নিজেদের প্রার্থী বাছাই করেন।
অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে প্রাইমারি ও ককাস শেষ হলে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় কনভেনশনের (সম্মেলন) মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও তার রানিংমেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই করে। এরপরই শুরু মূলত প্রার্থীদের প্রচার।
সাধারণত জুন বা জুলাই মাসে প্রধান দুই দলের দুই প্রার্থীর টেলিভিশন বিতর্কের মধ্য দিয়ে শুরু আনুষ্ঠানিক লড়াই। এরপর থেকেই তারা বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ঘুরে বেড়ান ভোটারদের মন জয় করতে। আর শেষ সময়ে এসে নামেন ‘সুইং স্টেট’ বা দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে।
এবারও প্রচারের শেষ সময়ে দোদুল্যমান রাজ্যগুলো চষে বেড়ান দুই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস। নির্বাচন নিয়ে করা জরিপগুলো দুই প্রার্থীর মধ্যে তুমুল লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে।
উত্তেজনাপূর্ণ এই নির্বাচনে জায়গা করে নিয়েছে বাংলা ভাষাও। এদিকে এবারের নির্বাচন নানা দিক থেকেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
ইউক্রেন থেকে গাজা ও লেবাননের যুদ্ধ পরিস্থিতি, চীন, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বিশ্বের সামরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণসহ একাধিক বিষয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নির্ভর করবে এই নির্বাচনের ফলাফলে।
দেশটিতে ২৪ কোটি ৪০ লাখ নাগরিক ভোটদানের যোগ্য, নিবন্ধিত ভোটার ১৬ কোটির মতো। ইলেকটোরাল কলেজের মোট ভোটার সংখ্যা ৫৩৮।
মেইন এবং নেব্রাস্কা এই দুটি রাজ্য বাদে বাকি সবগুলোর ইলেকটোরাল ভোট যোগ করলে যে প্রার্থী ২৭০টি পাবেন তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সেই প্রার্থীর রানিংমেট হয়ে যাবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। কমলার রানিংমেট টিম ওয়ালজ এবং ট্রাম্পের রানিংমেট জেডি ভ্যান্স।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অনেক বিষয় কাজ করে। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বর্ণবাদী। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সাদা-কালোয় কোনো ভেদাভেদ নেই। কিন্তু বাস্তবে বছরের পর বছর এ বর্ণবাদী প্রথা ভোটের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মোট ভোটারের প্রায় ৭৫ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ। শ্বেতাঙ্গরা রিপাবলিকান তথা ট্রাম্পের সমর্থক। কারণ, তাদের বেশিরভাগ ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’তে বিশ্বাসী।
বলা হয়ে থাকে, শ্বেতাঙ্গরা সবাই ভোট দিতে গেলে রিপাবলিকান প্রার্থী কখনো হারবেন না। বাস্তবে সব শ্বেতাঙ্গ ভোট দিতে যান না। এদিক বিবেচনায় নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি।
তবে কমলা হ্যারিসের মূল ভোট ব্যাংক নারী ভোটার। নারীরা মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। কমলা হ্যারিস নারীদের গর্ভপাত বৈধ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এতে নারীরা উচ্ছ্বসিত।
নারী ভোটারের উপস্থিতি বেশি হলে নাটকীয়ভাবে কমলা হ্যারিস জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
জেএন/পিআর