মানুষের ফুসফুসের রোগ নিউমোনিয়া। জীবাণু দ্বারা ফুসফুস আক্রান্ত হলে শরীরে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। ফলে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব পড়ে। এই রোগে শিশু এবং বৃদ্ধ মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়।
বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭ লাখের বেশি শিশু এ রোগে মারা যায়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ফুসফুসের জটিল রোগ নিউমোনিয়া। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের মতো মধ্যম ও স্বল্প আয়ের দেশে শিশু মৃত্যুর প্রথম কারণ এটি। শিশুদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। তবে শিশুর জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে নিউমোনিয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) সূত্র জানায়, গেল বছর (২০২৩ সালে) এ রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২ লাখ ৪ হাজার ৪২১ জন। তার মধ্যে ২২ হাজারেরও বেশি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।
দেশে চলতি বছরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ লাখ ১৬ হাজার ৪২৬ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৫৯৩ জন রোগী নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
শনিবার দুপুর দেড়টা। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের সাত তলার ৭১২ নম্বর নিউমোনিয়া ওয়ার্ডের বারান্দায় ১৩ মাসের আরবিকে কোলে নিয়ে পায়চারি করছিলেন মা সুমাইয়া আক্তার।
মায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা হাড্ডিসার আরবির নিঃশ্বাসের সঙ্গে বুকের ওঠানামা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসের ধকল সইতে না পেরে ক্ষীণস্বরে সে কান্না করছিল।
সুমাইয়া বলেন, জন্মের ৬ মাস বয়স থেকেই আরবির ঠান্ডাজনিত সমস্যা শুরু হয়। ঠান্ডা থেকে সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে তার ফুসফুসে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।
বছরের বেশিরভাগ সময় সর্দি-জ্বর ঠান্ডা তার লেগেই থাকে। আবহাওয়া পরিবর্তনের শুরুতে আবারও আরবির নিউমোনিয়া জনিত শ্বাসকষ্ট বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট প্রদাহজনিত শ্বাসযন্ত্রের রোগ। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় হাঁচি-কাঁশি মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। তবে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য।
চিকিৎসকরা আরও জানান প্রতি বছর বাংলাদেশে আনুমানিক ৮০ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার মৃত্যুবরণ করে। প্রত্যন্ত এবং অনুন্নত অঞ্চল যেখানে অপুষ্টি এবং বায়ু দূষণের প্রকোপ বেশি সেখানে নিউমোনিয়া প্রকোপও বেশি দেখা যায়।
তবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) তথ্য মতে, দেশে বছরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে ২৪ হাজার শিশু। ৬ লাখ ৭৭ হাজার শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, দেশে মোট শিশু মৃত্যুর প্রায় ১৮ শতাংশই হয় নিউমোনিয়ার কারণে। এমনকি বিশ্বে নিউমোনিয়ার কারণে প্রতি বছর পাঁচ বছরের কম বয়সি ১৪ লাখ শিশু মারা যায়, যা বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মোট মৃত্যুর ১৮ শতাংশ।
ইউনিসেফের মতে, বিশ্বে প্রতি ৩৯ সেকেন্ডে একজন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। ৬৫ বছর বয়সি সিওপিডিতে আক্রান্তদের নিউমোকোক্কাল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একজন সুস্থ ব্যক্তির চেয়ে ৭ দশমিক ৭ গুণ বেশি।
যাদের হাঁপানি রয়েছে তাদের ঝুঁকি ৫ দশমিক ৯ গুণ বেশি। ৫০ বছরের বেশি বয়সি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বছরে ১৬ লাখ মানুষের নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর জন্য বায়ু দূষণ এবং ধূমপান দায়ী বলে মনে করা হয়।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাবিল আকন্দ বলেন, অল্প বয়সি শিশু, প্রবীণ ও যাদের হৃৎপিন্ড বা ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে তাদের গুরুতর নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
ফুসফুসের ছোট ছোট বায়ু থলিতে জীবাণুর সংক্রমণের ফলে এই প্রদাহের সৃষ্টি হয়। আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রায় ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ।
নিউমোনিয়া সংক্রমণের পরে শরীরে যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায় এ প্রসঙ্গে ডা. নাবিল আকন্দ বলেন, কাশি এবং তার সঙ্গে হলুদ বা সবুজ রঙের কফ। শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট। কাশির সময় বুকে ব্যথার অনুভূতি। বুকের ভেতরে ঘরঘর আওয়াজ।
শরীরে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বরের সঙ্গে শরীরে ব্যথা, ক্লান্তি এবং খাবারে অরুচি দেখা দেয়। এসব মধ্যে একাধিক লক্ষণ প্রকাশ পেলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ডা. নাবিল আকন্দ বলেন, নিউমোনিয়া থেকে সাধারণ সর্দি আলাদা। কারণ নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট রোগ। এর ফলে মানবদেহের ফুসফুসকে সরাসরি সংক্রমিত করে। এটি অধিক জ্বর, কফসহ কাশি এবং শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গের দিকে নিয়ে যায় যেখানে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
অন্যদিকে সাধারণ সর্দি জ্বর তিন-চার দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। এতে মৃত্যু ঝুঁকি থাকে না। একই সঙ্গে শিশুর জ্বর সর্দি হলে কিংবা ঠান্ডা লাগলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার না করা পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকাদান কর্মসূচির এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় নিউমোনিয়া প্রতিরোধের ক্ষেত্রে দুটি টিকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে নিউমোকোক্কাল ভ্যাকসিন (পিসিভি ও পিপিএসভি)। এই টিকা দেওয়া থাকলে সাধারণত নিউমোনিয়া শিশুদের কাবু করতে পারে না।
এর বাইরে যেসব শিশুর অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদের প্রতি বছরই ফ্লু ভ্যাকসিন দিয়ে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করার ভালো উপায়। এতে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
এদিকে এমন প্রেক্ষাপটে নিউমোনিয়া সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস-২০২৪। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘চ্যাম্পিয়নিং দ্য ফাইট টু স্টপ নিউমোনিয়া’ অর্থাৎ আসুন নিউমোনিয়া বন্ধ করার লড়াইয়ে সক্রিয় সহযোগী হই’।
দিবসটি উপলক্ষে সব হাসপাতালের রেসপিরেটরি বিভাগ, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও লাং ফাউন্ডেশন সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
এছাড়া সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে চিকিৎসক, নার্স ও রোগীদের নিয়ের্ যালি, আলোচনা সভা ও সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হবে।
জেএন/পিআর