বিশেষ প্রতিবেদন : সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলেও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সারাদেশেই বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে চলতি বছরে বেশি আক্রান্ত হয়েছে রোগটিতে।
এক বছরে দেশে নতুন করে HIV শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৪শ ৩৮ জন। বিভাগ হিসেবে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী শনাক্ত হয় চট্টগ্রামে। ২০২৪-এ প্রায় ১৫০ জন এইচআইভি আক্রান্ত।
যার মধ্যে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম অঞ্চলেই এইচআইভি পজেটিভ রোগী ৭০ জন বলে জানা গেছে। তাছাড়া কয়েক হাজার রোগী এ ভাইরাসের চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন।
জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্তের পর থেকে বহু বছর ধরেই এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অ্যান্টি রেট্রো ভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টার।
এ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলতি বছরে নতুন করে এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্ত (পজেটিভ) রোগীর সংখ্যা ৭০ জন। যা গেল বছরের তুলনায় ১৪ জন বেশি।
২০২৩ সালে প্রাণঘাতী এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ৫৬ জন। ২০২২ সালে ৮৯ জন, ২০২১ সালে ৪২ জন, ২০২০ সালে ৪৪ জন, ২০১৯ সালে ৪৪ জন এবং ২০১৮ সালে ৪৫ জন রোগী এইচআইভি পজেটিভ ছিলেন।
এছাড়া নতুনদের নিয়ে এ বছর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের এআরটি সেন্টার থেকে সর্বমোট এইচআইভি আক্রান্তসহ মোট ২ হাজার ৬৭ জন রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেছেন।
চমেক হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. জুনায়েদ মাহমুদ খান জানান, HIV এমন এক ভাইরাস, যে ভাইরাস মানুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করার পর তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। ফলে HIV আক্রান্ত রোগী যে কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
তবে এইডসে আক্রান্তের সংখ্যা গেল বছরের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও সংস্থার অত্যধিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম আর চিকিৎসা সেবা বৃদ্ধির কারণে রোগটিতে মৃত্যুভয় অনেক কমে এসেছে।
এ চিকিৎসক মনে করেন নিয়মিত ওষুধ সেবন (যা এআরটি সেন্টার থেকে বিনামূল্যে দেওয়া হয়) এবং নিয়মিত ফলোআপ করলে এখন এ রোগ নিয়েও সুস্থ থাকা যায়।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই শিরায় মাদক গ্রহণকারী, যৌনকর্মী, হিজড়া, সমকামী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি শনাক্তের প্রবণতা বেশি। কারণ তারাই বেশিরভাগ সময় বৈষম্যের শিকার হন।
এই বৈষম্য স্বাস্থ্য সেবায়ও প্রকট। কুসংস্কার, ভয় ও লজ্জার কারণে যেন এই ব্যক্তিরা চিকিৎসা সেবা থেকে হারিয়ে না যান, সেদিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। তা না হলে তাদের মাধ্যমে নতুন ব্যক্তি সংক্রমিত হতে পারে।
এইডস নিয়ে কাজ করা চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম জানালেন, চট্টগ্রামের এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্তদের একটি বড় অংশ প্রবাসী। শুধু সরকারি হাসপাতালে নয়, ব্যক্তিগতভাবে এইডসের চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের মধ্যেও প্রবাসীর সংখ্যা বেশি।
এর কারণ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক জানালেন, প্রবাসীরা দীর্ঘদিন তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। তারা বিদেশে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণে জড়িয়ে পড়ে।
সেক্সুয়াল প্রটেকশন বা এইচআইভি ভাইরাস সম্পর্কিত ধারণা তাদের মধ্যে না থাকায় এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে নিজের অজান্তেই এ ভাইরাসের জীবাণু বহন করে।
তবে দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান না করে নির্দিষ্ট সময় পরপর দেশে এসে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকার মানসিকতা তৈরি করতে পারলেও এই রোগে আক্রান্তের হার কমবে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।
অন্যদিকে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কক্সবাজার জেলা হাসপাতাল, কক্সবাজার কারাগার ও আইওএম ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রায় ১২শ রোহিঙ্গা এইডসের চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডাইরেক্টর টিবিএল ও এইডস বা এসটিডি প্রোগ্রাম ডা. মাহফুজার রহমান সরকার জানান, আমাদের পরীক্ষা করার সক্ষমতা বেড়েছে। তাই পরীক্ষা বেশি হওয়ায় শনাক্তও হয়েছে বেশি।
তাই সংক্রমণ বেড়েছে, সেটা বলা যাবে না। তা ছাড়া আক্রান্তদের চিকিৎসার আওতায় আনা হয়েছে। তাই রোগটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম।
তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার বেশি। ১১ হাজার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্যে ১১০ জন এইচআইভি আক্রান্ত। এসটিডি কন্ট্রোল প্রোগ্রামে এইচআইভি প্রতিরোধে সচেতনতা অন্যতম।
সংক্রমিত ব্যক্তি পরিবারের প্রিয়জনের কাছেও নিজের রোগের কথা প্রকাশ করতে চান না। এ কারণে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আচার-আচরণগত দিক থেকে এইচআইভিতে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
নারী ও পুরুষ যৌনকর্মী, শিরায় মাদকদ্রব্য গ্রহণকারী, সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এইচআইভি কীভাবে ছড়ায়—সে বিষয়ে বেশি প্রচার চালাতে পারলে সচেতনতা বাড়বে। এতে স্টিগমা অনেকটাই কমে যাবে।
এইডস বা এসটিডি প্রোগ্রামের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এইডসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার ৬৯। চার বছর ধরে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি (এইডসের ভাইরাস) পজিটিভ ব্যক্তি শনাক্ত হয়। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের বছর বাদ দিলে গত ১০ বছরে এইচআইভিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল।
তথ্য বলছে, দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্তের পর হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৩২, ২০২১ সালে বেড়ে হয় ৮ হাজার ৭৬১।
এর পরের বছর ২০২২ সালে ৯ হাজার ৭০৮ জন এবং ২০২৩ সালে এই সংখ্যা পৌঁছে যায় ১০ হাজার ৯৮৪ জনে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৪৩৮ জন নতুন করে এইডসে আক্রান্ত হয়েছেন।
এইডসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও এ বছর রোগটিতে মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। তবে বয়সে তরুণদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্তের হার বেড়েছে।
চলতি বছর নতুনভাবে আক্রান্তদের মধ্যে ৬৩ ভাগেরই বয়স ২৫ থেকে ৪৯ বছর। আর ২১ ভাগের বয়স ২০ থেকে ২৪ বছর। গত বছর তরুণ বা ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ছিল ১৬ ভাগ।
এ বছর মোট আক্রান্তের মধ্যে পুরুষ ৭৭ শতাংশ, নারী ২২ শতাংশ, হিজড়া ১ শতাংশ। মোট সংক্রমণের ১০ শতাংশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এক বছরে দেশে নতুন করে আক্রান্ত ১৪৩৮ জন এইডস রোগীর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৯৫ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসটিডি বা এইডস শাখার তথ্যমতে, নতুনভাবে সংক্রমিতদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ বিবাহিত, ৪০ শতাংশ অবিবাহিত, ৫ শতাংশ বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত।
দেশের আট বিভাগে নতুনভাবে সংক্রমিতদের সংখ্যা ঢাকায় ৪০৬ জন, চট্টগ্রামে ৩২৬, খুলনায় ১৫৪, রাজশাহীতে ১৪৭ এবং অন্যান্য বিভাগে ৪৪ থেকে ৮৬ জন।
এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব এইডস দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘অধিকার নিশ্চিত হলে; এইচআইভি/এইডস যাবে চলে।’ প্রতি বছরের ১ ডিসেম্বর পালিত হয় এ দিবস।
জেএন/পিআর