বাজারে গত এক মাস ধরে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল ব্যবসায়ীরা। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি বলে এনবিআরকে দিয়ে ১৭ অক্টোবর ও ১৯ নভেম্বর দুই দফায় ১০ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে নিয়েছিল।
তারপরও তারা বাজারে তেলের সরবরাহ ঠিকমতো করেনি। এতে বাজারে কৃত্রিম ভোজ্য তেলের সংকট দেখা দেয়।
অবশেষে সোমবার (৯ ডিসেম্বর) সরকার প্রতি লিটার তেলে ৮ টাকা দাম বাড়িয়ে দেয়। দাম বাড়ানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বাজারে তেলের সয়লাব দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীদের এই পরিকল্পিত তেলেসমাতির ফাঁদে সরকার পা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের পরিকল্পিত পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সরকার মূলত নতি স্বীকার করেছে। কেননা বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, ‘বাজারে তেলের সংকট নেই। ঘাটতির মূল কারণ হচ্ছে বাজার ব্যবস্থাপনা।’
নাজের হোসাইন বলেন, এ কথা থেকেই বোঝা যায় সরকার বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না। বাজার ব্যবস্থাপনায় সঠিকভাবে তদারকি করতে পারছে না। এর দায় তাদেরকেই নিতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা আগেই বলেছিলাম; বাজারে তেলের সংকট যা তৈরি হচ্ছে, তা ব্যবসায়ীদের করা ফাঁদ। আর সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে সেই ফাঁদেই পা দিয়েছে।
বিশ্ববাজারে যদিও দাম বেড়েছে সেক্ষেত্রে সেই প্রভাব এত দ্রুত বাড়ার কারণ নেই। কেননা এখন যেসব তেল বাজারে আছে তা তো অনেক আগে আমদানি করা হয়েছে। আর সরকার লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর পরই ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বাজারে তেলে সয়লাব।
এতে এটাই প্রমাণ করে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা করে এই ফাঁদ তৈরি করেছিল। সরকারের দাম বৃদ্ধির এমন সিদ্ধান্তে আমরা ভোক্তারা হতাশ।
সরকার দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের আশা পূরণ করেছে কি না প্রশ্ন করা হলে ক্যাবের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এটা অনেকটা সেই ধরনের অবস্থাই বলা যায়।
যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে সেটি অল্প সময়ে কীভাবে প্রভাব ফেলবে। তা ছাড়া এখন বাজারে যে অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে মনে হয়, না পাওয়ার চেয়ে বেশি দামে পেলে কিছুটা রক্ষা।
সরকার নিশ্চয় হিসাব-নিকাশ করেই দাম বাড়িয়েছে। ব্যবসায়ীদেরও বিষয়টি মনে রাখতে হবে কৃত্রিম সংকট কারও জন্যই ভালো না। তারা দাম বাড়িয়ে নিজেদের আশা পূরণ করিয়ে ছেড়েছে।
এদিকে তেলের দাম বাড়ানোর পর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। দোকানগুলোতে বোতলজাত তেলের সরবরাহ বেড়েছে। মীর তাওসিফ নামে একজন ফেসবুকে লেখেছেন, গত কয়েক দিনে মানুষের মুখে মুখে শোনা গেছে, বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল মিলছে না।
এমনকি আমি নিজেও রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট, টাউন হল বাজার, হাতিরপুল বাজার ঘুরে এই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। অথচ দাম বাড়ানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বাজারগুলোতে তেলের সয়লাব দেখা যাচ্ছে।
দাম বাড়িয়ে বাজার স্থিতিশীল করা কোনো সমাধান নয় বরং মজুদদারকে চিহ্নিত করাই আসল কাজ হতো বলে মন্তব্য করেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রিপন কুমার মণ্ডল।
তিনি বলেন, দাম বাড়িয়ে তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখা ভালো কোনো সমাধান নয়। বরং বিকল্প জোগান নিশ্চিত করাই ছিল আসল কাজ।
সরকার সেটি না করে ব্যবসায়ীরা যা চেয়েছে অর্থাৎ দাম বাড়নো তাই করেছে। এতে যারা মজুদ করেছে তাদের শনাক্ত করা গেল না। সরকারের উচিত ছিল যারা মজুদ করেছে তাদের চিহ্নিত করা। কেননা দাম বাড়ানোর কিছু পরেই সব বাজারে তেলের সরবরাহ বেড়ে গেছে।
এই মুহূর্তেই কী করে তেল চলে এলো? এসব তো কোথাও না কোথাও স্টক করে রাখা হয়েছিল। সরকার তার জনবল দিয়ে তা বের করতে পারল না।
এই বাজার বিশ্লেষক বলেন, সরকারের বিকল্প জোগানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। একটি স্থান থেকেই তেলের সরবরাহ এলে তারা যা চাইবে তাই করবে। এটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
সরবরাহ স্বাভাবিক করতে অন্যান্য পথ অবলম্বন করতে হবে। শুধু দাম বাড়িয়ে দিয়ে সমাধান হবে না। এতে আগামীতে আবারও এই ধরনের সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হবে।
তিনি বলেন, সরকার কোনো পণ্যের দাম কমালে সেটি সহজেই কমে না। তখন বরং যুক্তি দেওয়া হয় এসব আগের দামে কেনা, কিন্তু যখন দাম বাড়ে সেই সময় তাৎক্ষণিক দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
সোমবার বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীনের সভাপতিত্বে ভোজ্য তেলের মূল্য সমন্বয় করতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়। এ সময় বৈঠকে তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রথম সিদ্ধান্তে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। এতে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ও খোলা পাম সুপার তেল বিক্রি হবে ১৫৭ টাকায়।
প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হবে ১৭৫ টাকা এবং প্রতি ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম হবে ৮৫২ টাকা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েন বিজ্ঞপ্তি জারি করবে।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে আমদানি পর্যায়ে আরোপিত বিদ্যমান সংযোজন কর (মূসক)-এর মেয়াদ আগামী ১৫ ডিসেম্বর থেকে বৃদ্ধি করে ৩১ মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত নির্ধারণ করবে।
তৃতীয় সিদ্ধান্ত হচ্ছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুযায়ী ভোজ্য তেলের মূল্য সমন্বয় করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাবে।
আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সে অনুযায়ী সভা করবে। বর্তমানে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকা ও খোলা সয়াবিন তেল ১৪৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে তেলের ঘাটতি রয়েছে, এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভোক্তারাও অস্বস্তিতে রয়েছে। সেজন্য আমরা তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছি। নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করি বাজারে আর তেলের ঘাটতি হবে না।
তিনি বলেন, গত এপ্রিলে ১৬৭ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর এখন পর্যন্ত বিশ্ববাজারে দাম অনেকটাই বেড়েছে। যে কারণে দেশে স্থানীয় মজুতদারি বেড়েছে। তেলের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। অনেকে কিনে মজুত করেছে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আমরা সেটা মনিটরিং করছি। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে এখন একটি যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর সমস্যা হবে না।
এ সময় ভোজ্য তেল সরবরাহকারী কোম্পানিরগুলোর সংগঠনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার বলেন, কয়েক দিন থেকে আমরা কীভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করেছি।
বিশ্ববাজারে প্রতি টন তেলের দাম ১ হাজার ২০০ ডলারে উঠেছে। গত এপ্রিলে সরকার যখন তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তখন বিশ্ববাজারে প্রতি টন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ৩৫ ডলার। এখন আমরা ১ হাজার ১০০ ডলার ধরে লিটারে ৮ টাকা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
উপদেষ্টা বলেন, এখন আমাদের প্রতি টন তেল ১ হাজার ২০০ ডলারে খালাস হচ্ছে। আরও দাম বাড়তে পারে, সে উদ্বেগ এখনও রয়ে গেছে। কারণ বিশ্ববাজার এখনও স্থিতিশীল নয়।
এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হচ্ছে। তবে আলুর দামে অস্থিরতা এখনও আছে। নতুন আলু উঠলে দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে কমে আসবে বলে আশা করছি।
জেএন/পিআর