জনগণের কিভাবে উন্নয়ন হবে, সেটার জন্যই কাজ করবে জনপ্রশাসন। জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে জনপ্রশাসনকে সুন্দর কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো সকলের দায়িত্ব। সরকারের উদ্দেশ্য জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা। জনপ্রশাসনে শর্ষের মধ্যে থাকা ভূত তাড়াতে জনগণই একমাত্র ভরসা। এ জন্য জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের কাজ স্বচ্ছ রাখতে, নাগরিকরা সেবা চাচ্ছেন বা সেবা পেতে কোথায় সমস্যা দেখছেন এবং সমাধান কীভাবে সম্ভব, সেসব বিষয়ে নাগরিকদের মতামত জানা প্রয়োজন।
আজ ২৩ ডিসেম্বর সোমবার সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে মতবিনিময় সভায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা এসব কথা বলেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বক্তবক্য রাখেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমদ, ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া, ড. মো. হাফিজুর রহমান ভূঁইঞা, মেহেদী হাসান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন ও চবি’র আইন অনুষদের অধ্যাপক এবিএম আবু নোমান।
মতামত ব্যক্ত করেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব অর্ন্তবর্তী কমিটির সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি, সদস্য মুস্তফা নঈম, চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিএমইউজে) সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান, মানবাধিকার সংগঠক জেসমিন সুলতানা পারু, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাসেল প্রমূখ। এছাড়াও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সৈয়দ মাহবুবুল হক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ কামরুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল.এ) একেএম গোলাম মোর্শেদ খান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোঃ শরীফ উদ্দিন ও নানা শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিবর্গ মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমদ বলেন, বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-জনতার সম্মিলিত জনতার আন্দোলনে রক্তের বিনিময়ে জনগণকে সুখী-সমৃদ্ধ ও জনগণের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা আজ একটি অবস্থানে এসেছি। আমাদের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ বিশেষ করে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, কোরিয়া আমাদের সাথে রাষ্ট্রীয় জীবন শুরু করেছে। তারা আমাদের মতই একটি অনুন্নত জাতি ছিল। তারা আমাদের মতই নানা ধরণের জঠিলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। জনপ্রশাসন ও সার্বিক কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতার কারণে আমরা স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও কাঙ্খিত অবস্থানে যেতে পারিনি। বর্তমানে ঐতিহাসিক সময় অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। আমরা উন্নত জাতি হতে চাই। কোন ধরণের ভেদাভেদ না রেখে জনগণের কিভাবে উন্নয়ন হবে, সে লক্ষ্যে জনপ্রশাসন মানুষের কাছে সার্বিকভাবে দায়বদ্ধ থাকবে। জনপ্রশাসনকে কিভাবে জনমুখী করা যায় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এখানে দুর্নীতি নয়, থাকবে সততা, স্বচ্চতা ও দক্ষতা। তরুণরা কি বার বার রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করবে না, এ দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
‘দুর্নীতি-রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদ-জনপ্রশাসনের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল আছে’ বলে মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।
তিনি বলেন, দুর্নীতি ও রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদ ও জনপ্রশাসনের মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল আছে। কখনও কখনও দেয়ালটা ভেঙে একত্রিত হয়ে যায় এবং সেটা সমাজকে ক্ষতি করে। সেজন্য অনেকেই বলেছেন, একটা চেক এন্ড ব্যালেন্স দরকার। রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের মধ্যে এক ধরনের কাজ আছে, যা রাষ্ট্র এবং সমাজকে ক্ষতি করে। সরাসরি রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয় যেটা ব্যক্তি দল সরকার সবার ঊর্ধ্বে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের নাগরিকদের সমান অধিকার মৌলিক অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব জনপ্রশাসনের। তেমনি সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিযে নাগরিকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। সরকার এই কমিশন গঠনের সময় চারটি শব্দ উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে-প্রশাসনকে জনমুখী করা, প্রশাসনকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করা, নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলা ও সর্বোপরি দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলা। প্রায় দেড় যুগ ধরে প্রশাসনে নানা ধরণের অসংগতি, অনিয়ম, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলাসহ অনেক কিছু আমরা দেখেছি। সেগুলো থেকে বেরিয়ে এসে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে জনপ্রশাসনকে সুন্দর কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে গেছে। এ জন্য প্রত্যেকের গুরুত্বপূর্ণ মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, জনমনে একটি বিশাল প্রত্যাশা রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর সবক্ষেত্রে পরিবর্তন বা সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের কল্যাণে সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনার জনকল্যাণে ও রাষ্ট্রের জন্য অনেক কাজ করেছে। রাষ্ট্র সংস্কারে ১ লক্ষ ৫ হাজার নাগরিক অনলাইনে তাদের মতামত দিয়েছে। তাদেও মতামতড়–লো বিশ্লেষন করছি। ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও জনপ্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্যাডার সার্ভিসের বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সাথে আমরা মতবিনিময় করেছি। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা রাষ্ট্র পরিচালনায় কিভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কিভাবে সহায়তা করবেন, নাগরিকদের কিভাবে সেবা প্রদান করবেন সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদা খানম বলেন, সেবা জনমুখী করতে জনপ্রশাসনের বিকল্প নেই। এজন্য সর্বস্তওে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত জরুরী। স্বল্প সময়ে সকল ধরণের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য শিক্ষার্থী প্রতিনিধি মেহেদী হাসান বলেন, যাদের পকেটে টাকা আছে তারাই ঘুষ দেয়। সমাজের তথাকথিত এলিট শ্রেণি এই ঘুষ প্রথা চালু করে। রাজনীতিবিদ তার কমিটমেন্টের বাইরে কাজ করলে তাকে প্রতিহত করবো। কেউ ঘুষ চাইলে তাকে প্রতিহত করবো। যারা আইন তৈরি কওে, তারাই আইন ভাঙে। তাই এই শর্ষের মধ্যে থাকা ভূত তাড়াতে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে।
সভায় গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে মানবাধিকার সংগঠক ও ইলমা’র প্রধান নির্বাহী জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, যারা জনপ্রশাসনে যাচ্ছেন তারা আমাদেরই সন্তান। আমরা তার মেধাটা দেখি, কিন্তু নৈতিক চরিত্র দেখি না। এই জায়গাটা আমাদের দেখা দরকার। তৃণমূল পর্যায় থেকে ওপরের লেভেল পর্যন্ত এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হওয়া দরকার, যিনি নির্লোভ-নির্মোহ থাকবেন। শুধু সেবার কথাটা মনে রাখবেন। সবাই বলছেন-দলীয় দলীয়। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন-আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে না, কোথাও না কোথাও একটা সাপোর্ট আছে। আমরা সরাসরি রাজনীতি না করলেও নিজেকে ওই রাজনীতির বলয়ের বাইরে রাখতে হবে। যখনই প্রশাসনে রাজনীতিবিদরা ঢুকছে, তখনই দুর্নীতি ও বিচারহীনতা শুরু হয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, প্রশাসন এবং রাজনীতিবিদরা ইয়াবা ও তামাক বন্ধ করতে পারে নাই। খেলার মাঠ নেই, এখন কিশোর ক্লাব বন্ধ হয়ে গেছে। কিশোর ক্লাবগুলো ফিরিয়ে আনলে অনেককিছু বন্ধ হয়ে যাবে। যখন কোনো দুর্নীতিবাজকে ওএসডি করি, বদলি করি, এটা কোনো বিচার না। আমাদের প্রত্যেকের জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।
সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাসেল বলেন, প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। প্রশাসনকে স্বাধীন করে দিতে হবে। লাল ফিতার দৌরাত্ব্য কমাতে হবে। ১০ দিনের কাজ এক বছর দুই বছর লেগে যায়। অনেকেই ভূমি অধিগ্রহণের টাকা পাচ্ছেন না। প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।
জেএন/এমআর