২৯ আগস্ট ২০১৮। গভীর রাতে সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ সাবিনা আক্তার (ছদ্মনাম) নামে এক নারী মাদক পাচারকারীকে ইয়াবাসহ আটক করে। যথারীতি মাদক মামলায় আসামি হয়ে ৩২ বছর বয়সী সাবিনার স্থান হয় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে।
কিন্তু সাবিনার আটকের খবর জানতেন না তার স্বামী নাছির আহমেদ। তিনি তার স্ত্রীকে অপহরণ করা হয়েছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম আদালতে দায়ের করেন নালিশী (সিআর) মামলা। আদালত সেই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেন নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি)। তদন্তভার বর্তায় নগর পুলিশের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী কমিশনার (বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) মঈনুল ইসলামের ওপর। ডিবির কাছে খবর আসে সাবিনা ইয়াবাসহ আটকের পর দায়ের হওয়া মামলায় আছেন কারাগারে। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে ডিবি সাবিনাকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর বেরিয়ে আসে তাকে ইয়াবাসহ আটকের পেছনে থাকা অন্য এক গল্প।
ইয়াবাসহ আটকের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার নথিতে সাবিনাকে উল্লেখ করা হয় ইয়াবা পাচারকারী হিসেবে। অভিযোগ ছিল নিয়মিত ইয়াবা পরিবহন করতেন তিনি।
কিন্তু ডিবির তদন্তে উঠে আসে, ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট ঘটনার দিন সন্ধ্যায় সাবিনার স্বামী নাছির আহমেদ ঘরের জন্য বাজার করেন। বাসায় না গিয়ে গৃহকর্মীর হাতে বাজারের ব্যাগ দিয়ে চলে যান নগরের হালিশহরের বড়পোল এলাকায়। তার অনুপস্থিতির সুযোগে বাসায় ঢোকে নাছিরের আগের সংসারের ছেলে কামরুল হাসান খোকন, সুমন, রাকীব ও আরজু। তারা পাঁচজন মিলে মুখ বন্ধ করে সাবিনার। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কেউ সাবিনার চুল ধরে দেয়ালের সঙ্গে আছাড় দেয়। পেটে বাচ্চা আছে এমন সন্দেহে ইচ্ছেমতো পেটে লাথি মারে। আগে থেকে স্কচটেপে মুখ বন্ধ থাকায় সাবিনার চিৎকার পরিণত হয় গোঙানিতে। আর সেই গোঙানিও সহ্য হয়নি খোকনদের। গোঙানি বন্ধ করাতে মুখে বসিয়েছে কামড়। এরপর তাকে খোকন ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর তার ওপর চলে আবারো শারিরীক নির্যাতন।
এরপরে তাকে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় সীতাকুণ্ড। সেখানে সাবিনাকে মাইক্রো থেকে নামানো হয়।
এরপরের ঘটনাটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। কারণ সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ হাজির হয় ঘটনাস্থলে। স্বাভাবিকভাবে পুলিশকে দেখে পালিয়ে যাওয়ার কথা অপরাধীদের। ভিকটিমকে উদ্ধার করে হাসপাতালেও নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে সাবিনাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় ইয়াবা পাচারকারী হিসেবে! সাবিনার কাছ থেকে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে উল্লেখ করে দায়ের করা হয় মামলা। অবাক করা বিষয় হল, সীতাকুণ্ড থানায় দায়ের হওয়া ওই মাদক মামলায় সাক্ষী ছিলেন অপহরণকারী আলী শাহ, নাছির উদ্দিন, জহিরুল আলম গং।
এরপর এ মামলায় সাবিনাকে হাজির করা হয় আদালতে। আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করেন। পুলিশের সঙ্গে আগে থেকেই যোগসাজশ ছিল ওই ধর্ষক এবং অপহরণকারীদের- এমন প্রমাণ মিলেছে ডিবির তদন্তে। পুলিশ ও অপহরণকারীদের মোবাইল কললিস্ট চেক করে বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়।
তদন্তে আরো উঠে আসে, সাবিনার প্রথম স্বামী জোবায়েরের সঙ্গে তালাক হওয়ার পর তার বিয়ে হয় নাছির আহমেদের সঙ্গে। তালাকের পরও জোবায়েরের ক্ষোভ ছিল সাবিনার প্রতি। এদিকে নাছিরের প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের সঙ্গে সাবিনার বনিবনা ছিল কম। কারণ নাছিরের দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারছিল না তার আগের সংসারের সন্তানরা।
এরই মধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় জোবায়েরের। তারা সাবিনাকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। বিষয়টি জোবায়েরকেও জানায় তারা। এতে রাজিও হয় জোবায়ের। কিন্তু সাবিনার ওপর শারীরিক নির্যাতনের বিষয়ে কোনো তথ্য জানা ছিল না জোবায়েরের। সাবেক স্ত্রীকে কিছুটা ভোগাতে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর পক্ষপাতি ছিলেন তিনি। পুলিশের কাছে এমনই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন জোবায়ের। সাবিনার ওপর নির্যাতনের খবর জানার পর জোবায়েরের অনুশোচনার কথাও উঠে আসে তদন্তে।
ডিবির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নাছিরের প্রথম স্ত্রী মারা যায় তার দ্বিতীয় বিয়ের কয়েক মাস আগে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর মেয়েদের বিয়ে দেয় নাছির। তার ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা থাকতে শুরু করে। সন্তানরা রাজি না থাকলেও বৃদ্ধ নাছির আহমেদ বিয়ে করেন সাবিনাকে। নাছির আহমেদের প্রথম সংসারের সন্তানদের ক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে শংকাও ছিল বাবার দ্বিতীয় সংসারে সন্তান এলে তাদের সম্পত্তিতে অংশিদার বাড়বে।
এ ব্যাপারে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর জোন) এস এম মোস্তাইন হোসাইন জয়নিউজকে বলেন, আদালতের নির্দেশে নালিশি মামলাটি তদন্ত করে নগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম অপরাধীদের সনাক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনটি একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কারণ প্রতিবেদনের আলোকে এবং আদালতের নির্দেশে ভিকটিম সাবিনা আক্তার কারামুক্ত হয়েছেন।