বিদায়ী বছরে ৪০১ জন নারী ধর্ষণের শিকার

দেশজুড়ে ডেস্ক :

লেখার শুরু বিদায়ী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করছি। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকের রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি ঘটনা নিয়ে নিয়ে সরব ছিল গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

- Advertisement -

ঘটনাটি ঘটে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প সংলগ্ন একটি ভবনে, সেই ভবনের ৯ তলা থেকে নিচে পড়ে মারা যায় শিশু গৃহকর্মী প্রীতি উরাং।

- Advertisement -google news follower

শুধু ফেব্রুয়ারি মাস নয়, বছরের প্রতিটি মাস, সপ্তাহ, দিনে দেশের কোনো না কোনো স্থানে ঘটেছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। এসব ঘটনার একটার রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে এসেছে অন্য ঘটনা।

বছরজুড়ে এসব ঘটনার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা তো ছিল। এর পাশাপাশি দলবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্তকরণ, নারী ও কন্যাশিশু পাচার, এসিডদগ্ধ, যৌতুক, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, আত্মহত্যা, ফতোয়া, বাল্যবিবাহ, সাইবার ক্রাইমের ঘটনাসহ রয়েছে আরও অগণিত ঘটনা।

- Advertisement -islamibank

এসব ঘটনার সাক্ষ্য এ দেশের গণমাধ্যম। বছরজুড়ে নারী নির্যাতনের এমন আরও অনেক ঘটনা ছিল, যার কোনো নথি থানায় লিপিবদ্ধ হয়নি। আবার কিছু ঘটনা মাটির নিচে চাপা পড়ে চিরতরে হারিয়েও গেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১ জন নারী।

এর মধ্যে ধর্ষণ‑পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছে ১০৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় ১ জনকে। আসকের পক্ষ থেকে ৩১ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে এই প্রতিবেদন পাঠানো হয়।

এ ছাড়া ২০২৪ সালে ২১ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মারা যায় ১ জন। আর রহস্যজনক মৃত্যু হয় ৬ জনের। অন্যদিকে এ বছরে অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছে ১৪ জন নারী।

আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, ২০২৪ সালে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৬৬ জন নারী।

এ ছাড়া উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ২ জন ও খুন হয়েছে ৩ জন নারী। এ ছাড়া ২০২৪ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে মোট ৫২৩ জন নারী। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছে ২৭৮ জন এবং আত্মহত্যা করেছে ১৭৪ জন।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৫০৭ জন নারী। অন্যদিকে ২০২৪ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৭৭ নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হয় ৩৬ জন এবং আত্মহত্যা করে ৭ নারী।

আবার মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রেরিত ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন ২০২৪’ থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালে ১ হাজার ১৫১টি নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৮১টি নারী ও ৩৩১টি শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার মধ্যে ধর্ষণের ১৯২টি ঘটনা ঘটেছে বছরটিতে।

দলগত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮২ জন নারী, ধর্ষণ-হত্যার শিকার হয়েছে ৭ জন, ধর্ষণের চেষ্টার শিকার ১০৮ জন ও যৌন হয়রানির শিকার ১৩৮ জন। অ্যাসিড নিক্ষেপে আক্রান্ত হয়েছে ৯ জন নারী।

এ ছাড়া প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬২। অপরদিকে ৩৬ জন প্রতিবন্ধী নারী ও শিশু বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হয়েছে। আজ এ প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠায় এমএসএফ।

নারীর প্রতি সহিংসতা সমাজের একটি দীর্ঘকালীন ব্যাধি। যুগ যুগ ধরে চলমান এই ব্যাধির শেষ কোথায় তা কেউ বলতে পারে না। যুগ যুগ ধরে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সরকারের পাশাপাশি নারী ও মানবাধিকার সংগঠন বহুমাত্রিক কাজ করছে। কিন্তু নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা তো কমছেই না, বরং ধরনে ও মাত্রায় বাড়ছে।

এমনকি বৃদ্ধ ও শিশুরাও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। আবার ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল, সাইবার বুলিং, সামাজিক মাধ্যমের আইডি হ্যাকের মতো ঘটনাও ঘটছে।

আসুন জেনে নিই বছরজুড়ে নারী নির্যাতনের আরও আলোচিত কিছু ঘটনার কথা–

জানুয়ারি
বিদায়ী বছরের জানুয়ারি মাসে চলন্ত ট্রেনে (লালমনিরহাট এক্সপ্রেস) শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বাড়ি ময়মনসিংহ। তার মা গাজীপুরে একটি ছাত্রাবাসে রাঁধুনি হিসেবে কাজ করেন। গত ১৬ জানুয়ারি মঙ্গলবার ষষ্ঠ শ্রেণির ওই মেয়ে শিক্ষার্থী বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে গাজীপুরের জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিল। এ সময় হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলে আসলে ময়মনসিংহের ট্রেনে না ওঠে ভুলবশত লালমনিরহাট এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে পড়ে ওই শিক্ষার্থী। ট্রেনের টিকিট না থাকায় অ্যাটেনডেন্ট আক্কাছ গাজী তাকে প্রথমে বসতে দেয়। একপর্যায়ে কেবিন খালি হলে আক্কাছ গাজী তার কক্ষে নিয়ে শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে। এ সময় তার চিৎকারে ট্রেনে থাকা পুলিশ সদস্যরা ওই শিশু শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে।

ফেব্রুয়ারি
ফেব্রুয়ারি মাসে ঘুমন্ত মা-মেয়ের ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তদের ছোড়া অ্যাসিডে ঝলসে যায় ঘরে ঘুমিয়ে থাকা মা ও মেয়ের শরীর। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার সুজাতপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্বজনরা জানায়, রাতে মা ও মেয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। এ সময় কে বা কারা জানালা দিয়ে বাইরে থেকে অ্যাসিড ছুড়ে মারে। পরে তাঁদের চিৎকারে বাড়ির অন্যরা ছুটে আসে। মেয়ে মিলি আক্তার ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।

মার্চ
মার্চ মাসে শেকলে বাঁধা অবস্থায় এক তরুণীকে টানা ২৫ দিন ধরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। তাও এমনঘটনা ঘটে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার একটি বাসায়।

গত ৩০ মার্চ তরুণীর চিৎকারে জাতীয় জরুরি সেবার (৯৯৯) নম্বরে এক ব্যক্তি কল করলে পুলিশ তরুণীকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করে। পুলিশের ধারণা, এই ঘটনা গোপন ক্যামেরায় ধারণ করে বিদেশেও পাঠানো হয়েছে।

এপ্রিল
বিদায়ী বছরের এপ্রিল মাসে ঘুমন্ত স্ত্রীকে ২৭টি কোপ দিয়ে গুরুতর আহত করে এক ব্যক্তি। ২৫ এপ্রিল বরগুনার আমতলীতে ঘুমন্ত স্ত্রী শাহনাজ বেগমকে কুপিয়ে জখম কারার অভিযোগ ওঠে তাঁর স্বামী মাহতাবের বিরুদ্ধে।

পরে আহত অবস্থায় শাহনাজকে আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকেরা সংকটজনক অবস্থায় তাঁকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। স্বজনদের দাবি, শাহনাজের শরীরে ২৭টি কোপের চিহ্ন ছিল।

মে
বিদায়ী বছরের ৩০ মে কুষ্টিয়া জেলার ডেমরা উপজেলার মোকররমপুর ইউনিয়নের খেঁমিরদিয়ার ভাটাপাড়া গ্রামে হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় চার বছরের শিশুকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

জুন
জুন মাসে রাজধানীতে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় নববধূ। গত ২৮ জুন ছুটির দিনে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন সেই নববধূ। রাজধানীর খিলক্ষেতের বনরূপা প্রজেক্টে এ ঘটনা ঘটে। খিলক্ষেত থানা পুলিশ জানায়, ভিকটিম ও তাঁর স্বামী ঘুরতে গেলে রাত সাড়ে ৯টার দিকে বনরূপা এলাকায় সুমন নামের এক ব্যক্তি ও অজ্ঞাতনামা ৬ জন তাঁদের জোরপূর্বক ধরে ঝোপঝাড়ের মধ্যে নিয়ে মারধর করে। সেই সঙ্গে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। একপর্যায়ে তারা ভিকটিমের স্বামীকে মুক্তিপণের টাকা আনার জন্য ছেড়ে দেয়। এরপর নববধূকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে চারজন।

জুলাই
জুলাইয়ে সন্তান না হওয়ায় স্ত্রীকে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে নেত্রকোণায়। জেলার কেন্দুয়ায় ১৭ বছরের দাম্পত্য জীবনে সন্তান না হওয়ায় কলহের জেরে অ্যাসিড ছুড়ে স্ত্রীর মুখ ঝলসে দেন স্বামী। সংবাদ সূত্রে জানা যায়, গত ৫ জুলাই রাত পৌনে ৮টার দিকে হাফসা আক্তার তাঁর বাবার বাড়িতে অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হন। পরদিন রাতে এসিডে দগ্ধ হাফসা আক্তার বাদী হয়ে স্বামী হুমায়ুন কবির বাকিকে আসামি করে কেন্দুয়া থানায় মামলা করেন।

আগস্ট
বিদায়ী বছরের আগস্ট মাসে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার সাদেকপুর গ্রামে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। সংবাদ সূত্রে জানা যায়, নিহত দুই ছাত্রী দক্ষিণ ইউনিয়নের পয়াগ ময়না বেগম ইসলামিয়া হাফিজিয়া মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল। গত ২৩ আগস্ট ২০২৪ তারিখ শুক্রবার ওই দুই ছাত্রী মাদ্রাসায় যায়। ২৪ আগস্ট মাদ্রাসা থেকে মোবাইল ফোনে নিহতের পরিবারকে জানানো হয় তারা দুজন মাদ্রাসায় নেই। এরপর গত ২৭ আগস্ট উত্তরপাড়া বায়তুল করিম মসজিদের মুয়াজ্জিন আজান দিতে যাওয়ার সময় টর্চের আলোতে রাস্তার পাশের জমিতে লাশ দুটি পড়ে থাকতে দেখে আশপাশের লোকজন তাদের মরদেহ উদ্ধার করে ব্রাক্ষণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান যে, নিহত দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে।

সেপ্টেম্বর
গত ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের মূল ফটকের বিপরীত পাশে ছবির হাট এলাকায় ষাটোর্ধ্ব বয়সী এক নারীকে দুর্বৃত্তরা জোরপূর্বক তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে। ৮ সেপ্টেম্বর সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের মূল ফটকের বিপরীত পাশে ছবির হাট গেটের ভেতর থেকে ষাটোর্ধ্ব বয়সী ওই নারীকে অচেতন অবস্থায় শাহবাগ থানা পুলিশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করে।

অক্টোবর
বিদায়ী বছরের অক্টোবর মাসে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় ১৩ বছর বয়সী গৃহকর্মীকে আটকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। সংবাদ সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগীকে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়েছে। উদ্ধারের পর দেখা গেছে, তার সারা গায়ে জখমের চিহ্ন ছিল। তুলে ফেলা হয়েছে সামনের পাটির দাঁত।

১৯ অক্টোবর এক সংবাদকর্মীর সহযোগিতায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরেই এই কিশোরীকে নির্যাতন করছিলেন জিনাত। অবশেষে ১৯ অক্টোবর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধারের পর আহতকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

নভেম্বর
বিদায়ী বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকার সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের খাগান দত্তপাড়া এলাকার একটি জঙ্গল থেকে মস্তকবিহীন ও দুই হাতের কবজি কাটা অবস্থায় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সংবাদ সূত্রে জানা যায়, গত ১১ নভেম্বর রাতে স্থানীয়রা একটি মস্তকবিহীন মরদেহ দেখতে পেলে পুলিশে খবর দেয়। পরে পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে। পরে আশপাশে খোঁজাখুঁজির পর প্রায় ১৫০ গজ দূরে একটি পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় কাটা মাথা ও দুই হাতের কাটা কবজি উদ্ধার করে। নিহত তরুণীর গায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং তার মরদেহ ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

ডিসেম্বর
গত ২৪ ডিসেম্বর নড়াইল সদর উপজেলায় সংরক্ষিত ওয়ার্ডের এক নারী ইউপি সদস্যকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর মুখে বিষ ঢেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। জানা যায়, টিসিবির মালামাল বিতরণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় যুবক রাজিবুল পাওনা টাকা দেওয়ার জন্য ওই ইউপি সদস্যকে ফোন করেন। এরপর তিনি টাকা আনতে তাঁর ইউনিয়নের এক ব্যক্তির বাড়িতে গেলে রাজিবুলসহ কয়েকজন তাঁকে ধর্ষণ করে এবং ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। ভুক্তভোগী নারী বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দিলে তাঁর মুখে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে ভয়ে তিনি কাউকে কিছু বলেননি। তবে তিনি অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থতা বাড়লে পরদিন বুধবার সকালে তাঁকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় তিনি ছেলের কাছে তাঁর ওপরে নির্যাতনের বর্ণনা ও জড়িত ব্যক্তিদের নাম বলেন। ওই নারী (৫০) নড়াইল সদর উপজেলার একটি ইউনিয়নের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন।

নতুন বছরে নারী প্রতি সহিংসতা কমবে কিনা? এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম মনে করেন, ‘নতুন বছর শুরু হবে। নতুন বছরে নারী নির্যাতনের মাত্রা কমলে আমরা খুব খুশি হতাম। কিন্তু এটা ঘটার কোনো লক্ষণ দেখছি না। আমাদের সমাজে নারী ও পুরুষের ক্ষমতার ভিন্নতা রয়েছে। ক্ষমতার এই ভিন্নতার কারণে নারীরা যুগ যুগ ধরে নির্যাতন কিংবা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সামাজিক কাঠামো ভেতরে ক্ষমতার ভিন্নতার সূত্র লুকিয়ে আছে। আমাদের এই সূত্র উন্মোচন করতে হবে। সেই সূত্র দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, আর্থ‑সামজিক কাঠামো, সামজিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতির মাধ্যমে পরিবর্তন হতে পারে। এ ছাড়া নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার একটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে পারিবারিক সহিংসতা। আর এই পারিবারিক সহিংসতার পেছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে পারিবারিক আইনে অসমতা। ফলে নারীরা তাদের জীবনে অধিকারহীন থাকেন। তাই অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন জরুরি।’

ডা. ফওজিয়া মোসলেমের মতে, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নারী আন্দোলনকে আরও অনেক বেশি শক্তিশালী করা প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মকে নারী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। নারী বিদ্বেষী মনোভাব সমাজ থেকে দূর করতে নারী‑পুরুষ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মের মাধ্যমে নারীকে অপদস্ত করার মনোভাব সমাজ থেকে দূর করতে হবে। যেমন–গত মাসে জয়দেবপুরে হিল্লা বিয়ে হয়েছে। হিল্লা বিয়ে আইনত নিষিদ্ধ। এটা অনেক বছর বন্ধ ছিল। কিন্তু হঠাৎ কররই হিল্লা বিয়ে চালু হলো। তাই বলা যায়, নারীবিরোধী গোষ্ঠী আবার তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা ধর্মকে নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, নারীর চলাচলে বাধা দিচ্ছে, নারীর পোশাকের প্রতি আঙুল তুলছে, ধর্মকে হিংসা‑বিদ্বেষের কারণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু ধর্ম হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। ধর্মকে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না।’

মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রেরিত ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন ২০২৪’ থেকে আরও জানা যায়, ২০২৪ সালে আত্মহত্যা করেছেন ৪১৯ জন নারী। অপহরণ করা হয়েছে ১৫ জনকে, নিখোঁজ রয়েছে ২৯ জন নারী। নারীর প্রতি সহিংসতার শিকার হয়েছে ১১ জন প্রতিবন্ধী নারী। এ ছাড়া ২০২৪ সালে মোট ১৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণ‑চেষ্টার ঘটনায় সমাজপতিরা আপস করেছেন, যা প্রচলিত আইনকে অবজ্ঞা করে বেআইনিভাবে করা হয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল এ বিষয়ে বলেন, ‘পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রে নারীর অবস্থান থেকে আমরা বুঝতে পারি, নারীরা কেমন আছেন। আজকে আমরা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের পারিবারিক আইনের পরিবর্তন হয়নি। যদিও‑বা আমাদের সংবিধানে নারীর সমঅধিকারের কথা বলা আছে। আরও বলা আছে, দেশের সকল নাগরিকের জন্য আইন সমানভাবে কাজ করবে। কিন্তু আইন, আইনের নিজস্ব ধারায় চলছে না। ফলে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে বাধাহীনভাবে।’

সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য ও উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশ সামনের দিকে এগিয়ে চললেও নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব কমছে না। এর ফলে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। নারীর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে পারিবারিক পর্যায় থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পরিবার থেকেই শিশুদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা তাদের জীবনাচরণে মানবিক হবে এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। আশা করি, নারীর জন্য এমন এক সমাজ হবে, যেখানে নারীরা নির্যাতনের শিকার হবে না। সম্মান, আত্মমর্যাদা, সমতার অংশীদার হয়ে বাঁচবেন।’

জেএন/পিআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM