দিনভর অপেক্ষা করেও বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করাতে পারেনি রেলপথ মন্ত্রণালয়। ট্রেনের চালক, গার্ড ও টিকিট চেকারসহ সব রানিং স্টাফ এখন পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্তে অটল। ফলে গতকালের মতো আজ বুধবারও সারা দেশে বন্ধ থাকতে পারে ট্রেন চলাচল।
সোমবার রাত ১২টার পর থেকে শিডিউলের কোনো ট্রেনে চড়েননি রানিং স্টাফরা। ফলে এ প্রতিবেদন লেখা (রাত ১২টা) পর্যন্ত সারা দেশে ২৪ ঘণ্টা ধরে বন্ধ রয়েছে ট্রেন চলাচল। বাতিল করা হয়েছে আন্তঃনগর-লোকালসহ সব ট্রেনের যাত্রা। ভোগান্তিতেও পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। বাতিল হওয়া ট্রেনের টিকিটের পুরো টাকা যাত্রীদের ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত সব ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। যাত্রীরা টিকিট দিলে তাদের পুরো টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৪২টি আন্তঃনগর ট্রেনসহ ৬৬ জোড়া ট্রেন চলাচল করে। অন্যদিকে, সারা দেশে চলে ১০৬টি আন্তঃনগর ট্রেন। কিন্তু কোনো ট্রেনই আজ গন্তব্যে যাত্রা করেনি।
গতকাল সকালে ঢাকা লোকো শেড ঘুরে দেখা গেছে, সারিবদ্ধ রাখা হয়েছে ট্রেনের লোকোমোটিভগুলো (ইঞ্জিন)। রানিং স্টাফরা সেখানে জমায়েত হয়ে নিজেদের মধ্যে নানা আলোচনা করছেন। ট্রেনের রেকগুলো রাখা হয়েছে প্লাটফর্মে। রেকের প্রতিটি কোচের দরজা তালাবদ্ধ। স্টেশন এলাকায় নেই কোনো ইঞ্জিনের শব্দ। এ ছাড়া ফাঁকা প্লাটফর্মগুলোতে দেখা গেছে সুনসান নীরবতা।
রানিং স্টাফরা জানান, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের কোনো কথা নেই। দাবির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্টীকরণ চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ট্রেনে উঠব না। কারও কথায় কাজ হবে না। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল।
রাত ১২টায় কর্মবিরতি শুরু হওয়ার পর সকাল ১০টায় দেশের প্রধান ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে আসেন রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন রেলপথ সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম, রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আরিফ, বিআরটিসি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামসহ আরও অনেকে।
উপদেষ্টা ৩০ মিনিটের মতো স্টেশন এলাকা পরিদর্শন এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে চলে যান। তবে থেকে যান বাকি কর্মকর্তারা। স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় রেলপথ উপদেষ্টা বলেন, ‘স্টাফদের দাবির বিষয়ে আমাদের আলোচনার দরজা সবসময় খোলা আছে। প্রয়োজনে আমরা তাদের সঙ্গে আবারও আলোচনা করব এবং অর্থ বিভাগেও তাদের এ দাবি নিয়ে আলোচনা করব। কিন্তু যাত্রীদের জিম্মি করে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মসূচি দুঃখজনক।’
উপদেষ্টা চলে গেলেও বাকি কর্মকর্তারা বিকেল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। কিন্তু কোনো রানিং স্টাফ প্রতিনিধির সঙ্গে তারা আলোচনা করতে পারেননি। পরে তারাও রেলভবনের উদ্দেশে রওনা হন। রেলপথ সচিবের সঙ্গে বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্টেশনের ভিআইপি রুমে অপেক্ষা করেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস।
এক ফাঁকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগাযোগ হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে ইন্ডিরেক্টলি যোগাযোগ হচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করছি তারা আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। আলোচনার দ্বার খোলা আছে।’
কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে অচলাবস্থার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অর্থ বিভাগের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। এ রকম একটা মোমেন্টে তারা তো কিছু বলতে পারছে না। এ বিষয়ে আলোচনার স্কোপ আছে। উপদেষ্টা স্যার বলেছেন আলোচনা করবেন, সেখানে আমরা অর্থ বিভাগকে নিয়ে যাব।’
ট্রেনের যাত্রী পরিবহন করল বিআরটিসি
সকালে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে জানানোর পরপরই দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোতে পাঠানো হয় বিআরটিসির বাস।
সন্ধ্যায় বিআরটিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তাকিম ভূঁইয়া জানান, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মঙ্গলবার ৪০টি বাস পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জ, খুলনা, যশোর, রংপুর, জামালপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, ময়মনসিংহে ছেড়ে গেছে ১৭টি বাস। বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মতিঝিল, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ রুটে ১১টি বাস ছেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেট, ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছয়টি বাস ছেড়ে গেছে। বগুড়া ও সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পাঁচটি বাস খুলনা, নঁওগা, সান্তাহারে ছেড়ে গেছে এবং কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটের উদ্দেশে একটি বাস ছেড়ে গেছে। এসব বাসে গন্তব্য থেকে প্রারম্ভিক পথেও ফিরতে পারবেন যাত্রীরা। তবে, একই গন্তব্যে বেশি যাত্রী না হওয়ায় বাসগুলো পরিপূর্ণ হচ্ছে না।
বিআরটিসি চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ট্রেনের যেসব যাত্রী পরিবহন করেছি, তাদের টিকিটগুলো দিয়ে ক্লেইম করলে রেলওয়ে আমাদের টাকা দেবে। হুট করে বাস ম্যানেজ করতে অসুবিধা হয়নি। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠান আজ বন্ধ। যেসব বাসের কোনো শিডিউল ছিল না, সেসব জায়গা থেকে বাস ম্যানেজ করা হয়েছে। বিআরটিসি তার সক্ষমতা দেখিয়েছে।’
সন্ধ্যায় বাংলাদেশ রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছি। এটাকে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই। এখনও যদি রেলপথ মন্ত্রণালয় আমাদের দাবিকে অগ্রাহ্য করে, আমরা এটার দায়ভার নিতে পারি না। আমাদের এ কর্মসূচি ততক্ষণ চলমান থাকবে, যতক্ষণ রেলওয়ের বিধিবিধান অনুযায়ী আমাদের প্রাপ্যটা না পাব।’
সর্বশেষ রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের ভিআইপি রুমে রেলওয়ের কর্মীদের সঙ্গে তাকে আলোচনা করতে দেখা যায়।
রেলপথ নয়, অর্থ মন্ত্রণালয়কে স্পষ্টীকরণ চিঠি দিতে হবে
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন জানায়, কর্মচারীদের অবসরোত্তর ৭৫ শতাংশ মাইলেজ মূল বেতনের সঙ্গে যোগ করে পেনশন নির্ধারণের বিধান প্রায় ১৬২ বছর ধরে চলমান ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে রেলওয়ের কোডিফাইড রুল অমান্য করে রানিং স্টাফদের পার্ট অব পে হিসেবে গণ্য মাইলেজ, যা যুগ যুগ ধরে বেতন খাতের অংশ ছিল; সেখান থেকে সরিয়ে টিএ খাতে নেওয়ার ফলে জটিলতা তৈরি হয়। এরপর ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মাইলেজ যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানায়।
কর্মচারী ইউনিয়ন আরও জানায়, ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১০ এপ্রিল রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে অর্থ মন্ত্রণালয় ১৩ এপ্রিল চিঠিটি প্রত্যাহার করে নেয়। পরে তৎকালীন রেলমন্ত্রী ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে এ সমস্যা দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন। যার ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১১ জুন তৎকালীন রেলওয়ের মহাপরিচালক স্পষ্ট করে রানিং স্টাফদের মাইলেজ যোগে পেনশন এবং আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই বছরের ১৮ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আবারও আপত্তি জানায়। ফলে রানিং স্টাফদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করে।
এ বিষয়ে ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারির প্রথম প্রহর (রাত ১২টা ১ মিনিট) থেকে ট্রেন চালানো বন্ধ রেখেছি। ট্রেন চালানো বন্ধের বিষয় থেকে সরে আসতে গেলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে স্পষ্টীকরণ চিঠি দিতে হবে। রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্টীকরণ চিঠি দিলে হবে না। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়, এটা ১৬২ বছর ধরে চলে আসছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৬২ বছর ধরে চলে আসা একটা নিয়ম হুট করে বন্ধ করে দেবে, এটা রেলের কোনো স্টাফ মেনে নিতে পারে না। আমরা তাদের (কর্তৃপক্ষ) বারবার সময় দিয়েছি, বারবার আন্দোলন করেছি; বারবার প্রত্যাহার করেছি। কিন্তু এবার আর কোনো কিছু করার সুযোগ নেই।’
জেএন/এমআর