বালির রাজ্যে মহারাজা মহসীন আলী!

মিরসরাই প্রতিনিধি :

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বালির রাজ্যের এক মহারাজার নাম মহসীন। এই মহারাজা বালু মহসীন নামেও পরিচিত। এই মহারাজার রাজত্ব চলছে বিগত ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে।

- Advertisement -

দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন হলেও এই মহারাজার পরিবর্তন হয়না। নেতা আসে নেতা যায় আমলা আসে আমলা যায় কিন্তু মহসীনের রাজ্যে একফোঁটাও নড়চড় হয়না।

- Advertisement -google news follower

এই মহারাজা মিরসরাইয়ে রাজত্ব কায়েম করলেও তার বাড়ি কিন্তু মিরসরাইয়ে নয়। তিনি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার ১০ নং গোপাল ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড টেন্ডল বাড়ির বাসিন্দা।

এছাড়া তিনি গোপাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য। তিনি গোপাল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের একজন উচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টা ও অর্থ যোগানদাতা। গোপাল ইউনিয়ন, ছাগলনাইয়া থানা ও ফেনী সদর জেলা আওয়ামী রাজনীতিতে তার কদর রয়েছে।আশরাফ উদ্দিন

- Advertisement -islamibank

গেল ৫ আগষ্টের পূর্বে গোপাল ইউনিয়ন ও ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাকে বিশেষ অতিথি ও প্রধান অতিথি হিসেবে রাখা হতো।

তার বাড়ি গোপাল ইউনিয়নে হলেও ফেনী নদী থেকে বালি উত্তোলন ও প্রশাসনের কাজ থেকে বালি উত্তোলনের বৈধ অবৈধ অনুমতি আদায়ে তার রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

এই বৈশিষ্টের কারনে বালির রাজ্যে তিনি মহারাজা হয়ে উঠেছেন ধীরে ধীরে কয়েক দশকে। বিএনপি-জামাত-কিংবা আওয়ামী লীগ, সকলের মধ্যমনি তিনি।

ফেনী নদী থেকে বৈধ অবৈধভাবে বালি উত্তোলন ও বিপণন করতে গেলে মহারাজা মহসীনের সান্নিধ্যে আসতে হবেই, যে কোন রাজনৈতিক দলের যত বড় নেতা হোক না কেন।

তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ছাগলনাইয়া ও জোরারগঞ্জ থানার আড়াইশ সদস্যের বৃহত্তর ফেনী-বারৈয়ারহাট বালি উত্তোলন সমিতি।

৫ আগষ্টের পূর্বে এই সমিতির সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা ও জোরারগঞ্জ থানার হিংগুলী ইউপি চেয়ারম্যান সোনা মিয়া ছিলেন। ৫ আগষ্টের প্রেক্ষাপটে সোনা মিয়া চেয়ারম্যান পালিয়ে গেলে স্থানটি দখল করেন বারৈয়ারহাট পৌর বিএনপির আহ্বায়ক দিদারুল আলম মিয়াজি।

তবে দিদারুল আলম মিয়াজি দাবি করেন, তিনি বৃহত্তর ফেনী-বারৈয়ারহাট বালি ব্যবসায়ী সমিতি নয় বরং বারৈয়ারহাট ধুমঘাট বালি ইয়ার্ডে বালি রেখে জামায়াত ও বিএনপির যারা বালি ব্যবসায়ী তিনি তাদের মনোনীত সভাপতি। তবে সে যাই হোক না কেন সবার মাথার মধ্যমনি মহারাজা মহসীন।

মহসীন মহারাজা হওয়ার প্রধান কারণ প্রতি স্কয়ার ফিট বালি বিক্রয়ের ১৪ টাকা মাসোহারা। ১৪ টাকা দুই অঙ্কের সংখ্যাটা ছোট দেখালেও হিসাব করতে গেলে যে কারো চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। একটু হিসেব করলে দেখা যায় এই ১৪ টাকার অঙ্ক ১ কোটি ফিট বালিতে দাঁড়ায় ১৪ কোটি টাকা।

একটি হিসেবে দেখা যায় প্রতিদিন ফেনী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ৫শত শ্যেলো মেশিন ও ৫০ টি বোর্ট কাটার অবৈধ চরকাটা ও বালি উত্তোলনের সাথে জড়িত।

প্রতিটি শ্যলো মেশিন প্রতিদিন ২ হাজার ফিট ও প্রতিটি বোর্ট কম পক্ষে ২০ হাজার ফিট বালি উত্তোলন করে। এতে দেখা যায় প্রতিদিন ফেনী নদী থেকে গড়ে ২০ লাখ ফিট বৈধ বা অবৈধ বালি উত্তোলন করা হয়। এভাবে অন্তত বছরে ৬ মাস বালি উত্তোলন করলে ৩৬ কোটি ফিট বালি উত্তোলন হয় ফেনী নদী থেকে।

৩৬ কোটি ফিট বালিতে প্রতি ফিট ১৪ টাকা মাসোহারা হিসেব করলে টাকার অঙ্ক টা দাঁড়ায় ৫০৪ কোটি টাকা!!!

এখন নিশ্চয়ই আপনার চোখ কপালে উঠে গেছে। ঠিক তাই বছরে মাত্র ৬ মিসের এটি একটি আনুমানিক হিসাব। এই হিসাব পুরো বছরের পাশাপাশি বাস্তবতা হাজার কোটির কাছাকাছি। এই হাজার কোটি টাকার পুরো লেনদেন বালির রাজ্যে মহারাজা মহসীন বা বালি মহসীন নিজেই পরিচালনা করেন।

স্থানীয় অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই হাজার কোটি টাকা বন্টন করেন উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের কাছে। কথিত রয়েছে মহসীন এই বিশাল অঙ্কের মাসোহারা যায় তাদের কাছে। ৫ আগষ্টের পরেও তা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান কয়েকজন ব্যবসায়ী।

জানা গেছে, প্রতি ফিট বালি থেকে নির্ধারিত ১৪ টাকা চাঁদা জেলা প্রশাসন,উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় বিএনপি নেতা নুরুল আমিন চেয়ারম্যান, বারৈয়ারহাট পৌর বিএনপির আহ্বায়ক দিদারুল আলম মিয়াজি, বালি মহাল ইজারা দার বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের মালিক করেরহাট ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন ও লীজা এন্টারপ্রাইজের মালিক মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক কামরুল ইসলামের মাঝে বন্টন হয়। চাঁদার ৫০ পয়সা ব্যয় হয় মহসীনের ব্যক্তিগত খরচ, অফিস খরচ, স্থানীয় প্রশাসন ও সুশীল সমাজের মুখ বন্ধ রাখতে।

তবে একটি সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে এই প্রতিনিধির প্রশ্নের প্রেক্ষিতে কোন প্রকার রয়েলিটি নামক চাদার টাকার ভাগ নেননা বলে জানায় স্থানীয় দুই বিএনপি নেতা।

কিন্তু স্থানীয়দের অভিমত, যদি বিএনপি নেতারা রয়েলিটি নামক চাঁদার টাকা গ্রহন করে থাকেন তাহলে তাদের চোখের সামনে তাদের নিয়ন্ত্রিত অনুসারীরা কিভাবে রাতদিন বৈধ অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করছেন? বালু মহসীন যে ১৪ টাকা রয়েলিটি নামক বিশাল অঙ্কের চাদা আদায় করছেন তাহলে সেই টাকা কোথায় যাচ্ছে।

বারৈয়ারহাট ধুমঘাট ব্রীজ এলাকায় একটি বালি মহালে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় লিজা এন্টারপ্রাইজ নামে বালির চালান কাটা হচ্ছে। সেখানে একটি ট্রাকে ১৫০ ফিট বালি লোড় দেয়া হয়। ১৫০ ফিট বালি বোঝাই কৃত গাড়ি থেকে প্রতি সিএফটি ১৪ টাকা হারে ২ হাজার ১শত টাকা রয়েলিটির টাকা আদায় করা হয়।

লিজা এন্টারপ্রাইজের রশিদ বইয়ে বালির পরিমান লিখে চালান কাটা হলেও টাকার ঘর ফাঁকা রাখা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রশিদ কাটার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি জানান, এটাই এখানকার নিয়ম। টাকার পরিমান লিখা যাবে না। শুধু বালির পরিমান লিখতে হবে।

সারাদিন যা চালান কাটা হয় দিন শেষে বালি ব্যবসায়ী সমিতির অফিসে গিয়ে বালি মহসীনের কাছে হিসেব অনুযায়ী টাকা জমা দিতে হবে। এই টাকার সিএফটি অনুযায়ী যার যার ভাগ তার তার কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব মহারাজা মহসীনের।

মহারাজা মহসীন প্রকাশ বালি মহসীনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতি সিএফটি আড়াই টাকা বালি উত্তোলনের ইজারাদারের জন্য রেখে বাকি টাকা ফেরত দিয়ে দেয়া হয়।

যদি ফেরত দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ইজারাদারের রয়েলিটি আড়াই টাকার অতিরিক্ত সাড়ে ১১ টাকা কেন সংগ্রহ করা হয় ও সংগৃহীত অর্থের হিসাব কিভাবে রাখা হয় এবং কিভাবে ফেরত দেয়া হয় তার কোন সন্তোষজনক উত্তর তিনি দিতে না পেরে এই প্রতিনিধিকে দেখা করার প্রস্তাব দেন।

তিনি বলেন, সব কথা ফোনে বলা সম্ভব নয় আপনি অফিসে আসেন আপনাদের অনেকের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক আছে। আপনার চায়ের দাওয়াত।

এছাড়া বালির রাজ্যে মহারাজা আওয়ামী লীগের পৃষ্টপোষকতাকারী এই মহসীনের বিরুদ্ধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের হত্যা ও দমন নীপীড়নে ফেনী ও মিরসরাই আওয়ামী সন্ত্রাসীদের আর্থিক সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন ও ছাত্র হত্যার সম্পৃক্ততার অভিযোগে চট্টগ্রামের মিরসরাই থানা, জোরারগঞ্জ থানা ফেনী জেলার ফেনী মডেল থানা ও ছাগল নাইয়া থানায় ৫ আগষ্টের পরে বেশ কয়টি মামলার এজাহারে তার নাম রয়েছে বলে জানা গেছে।

জেএন/আশরাফ উদ্দিন/পিআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM