অবশেষে নির্মাণত্রুটি ‘সারিয়ে’ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। আসছে একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে একদিকে চলছে ধোয়া-মোছার কাজ, অন্যদিকে ত্রুটি সারানোর কাজও।
এর আগে, নির্মাণকাজ শেষ হলেও নকশা নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের আপত্তির কারণে গত তিন বছর শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব হয়নি। কখনো মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনার, কখনো বা কাট্টলীর অস্থায়ী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে হয়েছে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, সাবেক মেয়রের লোক দেখানো পদক্ষেপের কারণে শহীদ মিনারের সংস্কার সুপারিশ ঝুলে ছিল গোটা একবছর। আপত্তির মুখে সংস্কৃতিকর্মীদের মন রাখতে গত বছরের ২৮ মে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাতে উদ্যোগ নেয় চসিক। কিন্তু বিগত সরকারের ‘বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে’ শেষ পর্যন্ত ওই চিঠি মন্ত্রণালয়ে আর পাঠাননি সংস্থাটির প্রধান। শেষে ফাইলচাপা পড়ে যায় ওই চিঠি।
সেই চিঠির একটি কপি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। এমনকি সুপারিশ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটি করেই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে সংস্থাটি। গণপূর্ত অধিদপ্তরে চিঠি পাঠানোর কথা থাকলেও সেটিও আর পাঠায়নি চসিক। তবে, গেল সপ্তাহের শেষে এ নিয়ে টনক নড়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। চলতি সপ্তাহের শুরুতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়— নগরবাসী শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন সেখানে। অতঃপর এবারের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পর্দা উঠবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চসিকের নগর পরিকল্পনা শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারের ‘বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে’ ওই সময়ে সুপারিশ বাস্তবায়নের পদক্ষেপে পিছপা হন সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। সংস্কৃতিকর্মীদের মন রাখার জন্যই ওই চিঠি তৈরি করা হয়। কিন্তু সেটা আর পাঠানো হয়নি। পরে গণপূর্তকেও একটা চিঠি পাঠানোর কথা ছিল —সেটাও পাঠানো হয়নি।’
এর আগে, ১৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আনুষ্ঠানিকভাবে চালু না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়টা নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে একটা চিঠি পাঠানোর কথা ছিল। নানান কারণে তা সে সময় আর হয়নি। তবে এবার আমরা এ বিষয়ে একটা জোরালো পদক্ষেপ নিবো। আমরা মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবো; যাতে এবারের ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো যায়।’
এদিকে, গেল বছরের (২০২৪) শুরুতে পুরনো শহীদ মিনারের স্থানে নির্মিত নতুন শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ শেষ হয়। যদিও ২০২৩ সালের নভেম্বরে শহীদ মিনারের নকশা নিয়ে আপত্তি জানান চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তাঁদের দাবি ছিল, পরিবর্তিত নকশায় শহীদ মিনারের মূল ভাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু উপাদান যুক্ত করা হয়েছে, যা ভাষা শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করছে না। বিশেষ করে মিনারের উচ্চতা, ডিজাইন ও সংলগ্ন স্থাপত্যশৈলীর কিছু পরিবর্তনকে বিতর্কিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এরপর সে সময়ের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।
ওই সময়ে (২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি) সেই কমিটি নকশা সংশোধনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দৃশ্যমান করতে, মিনারের উচ্চতা বাড়াতে এবং প্লাজার ওপরের বেদিতে ওঠানামা সহজ করতে ১০টি সুপারিশ করে। সুপারিশগুলোর মধ্যে আছে— প্লাজার দক্ষিণ পূর্বের উন্মুক্ত মঞ্চের পিছনে থাকা গ্রিনরুমের দেওয়ালের উচ্চতা ফ্লোর লেভেল হতে ৬ ফুট বা মঞ্চ হতে ৪ ফুট রেখে অবশিষ্ট অংশ অপসারণ করা। এছাড়া দক্ষিণ পশ্চিমে থাকা ‘লিলি পন্ড ওয়াটার বডি’ অপসারণ, মূল বেদীর দুই পাশে বাঁকানো গাইড ওয়ালের উচ্চতা কমানো, পূর্ব পার্শ্বের প্রবেশ র্যাম্প ও সিঁড়ির মধ্যেকার দেয়াল অপসারণ করে পূর্ণাঙ্গ র্যাম্প করার সুপারিশ করা হয়।
সেই সুপারিশ অনুযায়ী বর্তমানে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে একটা র্যাম্প করা, কিছু দেয়ালের উচ্চতা কমানো এবং মূল শহীদ মিনারের উচ্চতা বাড়ানোর কাজ চলমান রয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের প্রকল্প বাস্তবায়নকারী গণপূর্ত বিভাগের চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ কামরুল হাসান খান বলেন, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্যে র্যাম্পের পাশে বাড়ানোর কাজ চলছে। এটা একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই আমরা শেষ করতে পারবো। আর শহীদ মিনারের আশপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ধোয়া-মোছার কাজ চলছে। আজ সকালে (১৭ ফেব্রুয়ারি) জেলা প্রশাসন, পুলিশ, সিটি কর্পোরেশন, গণপূর্ত সবাই মিলে পরিদর্শন করে প্রাথমিকভাবে কী কী করা লাগবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালে নগরের কেসি দে রোডে পাহাড়ের পাদদেশে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৭৪ সালে এর নতুন রূপ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে সভা করে পুরনো শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এর পরের বছর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীনে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের আওতায় পুরনো শহীদ মিনারটি ভেঙে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এরপর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে দেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। তারপর থেকে সেখানেই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নগরবাসী। পরবর্তীতে গত বছরের (২০২৪ সাল) ২৩ মার্চ নগরের উত্তর কাট্টলীতে সাগর তীরে অস্থায়ী স্মৃতি সৌধের উদ্বোধন করা হয়। ওই বছরের ২৬ মার্চ মিউনিসিপ্যাল মাঠের পরিবর্তে অস্থায়ী স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা জানান নগরবাসী।
যদিও এর আগে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এই সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। তখন ব্যয় ধরা হয় ২৩২ কোটি টাকা। পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে হয় ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
জেএন/এমআর