রাজীব সেন প্রিন্স : মিটারগেজ সেকশনে কম গতিসম্পন্ন ট্রেন প্রত্যাহার করে দ্রুতগতি সম্পন্ন ট্রেন প্রতিস্থাপন করার উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে ডেমু ট্রেনের যুগে প্রবেশ করেছিল বাংলাদেশ।
চীন থেকে ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয় ২০টি ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম দুই প্রধান শহরের অফিসগামী যাত্রীদের দ্রুত যাতায়াতের যে স্বপ্ন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছিলো এক দশক না পেরুতেই সব স্বপ্নই মাটি চাপা পড়েছে।
স্বপ্ন এখন রীতিমতো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০ সেট ট্রেনের জায়গা হয়েছে ট্রেনের হাসপাতাল (ওয়ার্কশপ)এ। প্রায় সবকটিই আছে লাইফ সাপোর্টে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে রেলওয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানায়, চীন থেকে কেনা সব ডেমু ট্রেনে বিদেশী সফটওয়্যার থাকায় মেরামত করেও সুবিধা করতে পারছে না দেশের প্রকৌশলীরা। বিকল অকেজো হয়ে ট্রেনগুলো পড়ে আছে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রেলওয়ের স্থাপনায়। বেশিরভাগ ডেমুর আস্তানা এখন মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা-চট্টগ্রাম ও পার্বতীপুর ওয়ার্কশপে।
বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী এলাকার রেলওয়ে ওয়ার্কশপে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পুরো এলাকা যেন ট্রেনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। রেল লাইনের এক কোণে পড়ে থাকা ট্রেনগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খসে পড়েছে।
ট্রেনগুলোর কোনোটির চাকা সচল নেই, ভেঙে গেছে জানালা। কোনো ট্রেনের জানালার কাচও অবশিষ্ট নেই। ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে আছে বহু আগেই। ভেতরের যন্ত্রাংশ, লাইট-ফ্যান খুলে নেওয়ায় প্রতীকী ট্রেন হিসেবেই অবশিষ্ট আছে এগুলো। তবে কয়েকটি দুর থেকে দেখতে নতুন মনে হলেও বাস্তবে সম্পূর্ণ অকেজো। আছে শিকলবন্দী হয়ে।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, এক দশক আগে সাড়ে ৬শ কোটি টাকায় কেনা ডেমু ট্রেনগুলো ৩০ বছর সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে সব ট্রেন চলাচল তো দুরে থাক, মেরামতের সক্ষমতাও না থাকায় নিলামে বিক্রির পরিকল্পনা করেছে রেলওয়ে।
অন্যদিকে কোন ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ট্রেনগুলো কেনার পেছনে রয়েছে সরকারী অর্থ অপচয়ের অভিযোগ। মেরামত ও যন্ত্রাংশ ক্রয়েও বড় অনিয়ম দুর্ণীতির বেশ তথ্য পাওয়া গেছে।
কয়েকজন রেলকর্মী অভিযোগ করে বলেন, ডেমু ট্রেন কেনার সময় এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো ওয়ার্কশপ নির্মাণ করা হয়নি। এমনকি রেলওয়ের কর্মীদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল না। দেশীয় বাজারে এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও অনুপস্থিত, ফলে দীর্ঘদিন ধরে মেরামতের উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে।
বর্তমানে ট্রেনগুলোর বড় অংশ মেরামত হতো চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকোশেডে। কিছু মেরামত কাজ চলে পার্বতীপুর কারখানায়।
রেলওয়ের মেকানিক্যাল বিভাগের একটি সুত্র জানিয়েছে চট্টগ্রামের লোকোশেডে থাকা ১০ সেটের মধ্যে এক সেট সচল আছে। চট্টগ্রামের ডেমুটি চলত চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেলপথে। দুটি ট্রেন পরিচালনার জন্য লোকোমাস্টার বা এলএম নেই। নেই গার্ড ও ক্রু। তাই দুই সেট ডেমু ট্রেন কারিগরিভাবে সচল থাকলেও চালানো যাচ্ছে না। তবে বহু দিন থেকে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট ও চট্টগ্রাম-বিশ্ববিদ্যালয় রেলপথে চলাচল বন্ধ। একসময় চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে চলাচল শুরু করলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তাও বন্ধ হয়ে যায়।
এরমধ্যে রেলওয়ের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ডেমুতে জ্বালানি খাতে বিপুল তেল ব্যবহার করার তথ্য পাওয়া গেছে। চলাচল বন্ধ থাকার সময়ই দুই সেট ডেমু ট্রেনে ১ হাজার ৭১২ লিটার জ্বালানি তেল ও ৩২২ লিটার লুবঅয়েল ব্যবহার দেখানো হয়েছে। বন্ধ থাকা দুটি ডেমু ট্রেনের বিপরীতে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৬ টাকার যন্ত্রাংশ ক্রয় দেখানো হয়। যা ডেমু খাতে বড় ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
রেলওয়ের পাহাড়তলী কারখানা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, মেরামত বাবদ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪০ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ডেমুর জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ কেনা বাবদ ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪১ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। দুই অর্থবছরে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ৭৮১ টাকা ব্যয় হলেও কোনো কাজে আসেনি। অথচ ট্রেনগুলো এক দিন চললে তিন দিন বন্ধ থাকত।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি/অপা.) মো. নাজমুল ইসলাম জানান, এর আগে কয়েকবার অর্থ খরচ করে মেরাতের পরও এসব ট্রেন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
ফলে এগুলো আর চালানোর কোন সম্ভাবনা কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, সেই সময়ে যারা কেনাকাটায় বা মেকানিক্যালের দায়িত্বে ছিলেন তারা বলতে পারবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেমু ট্রেন এখন জাদুঘরে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অথচ কম দূরত্বে আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য চীন থেকে আমদানি করা হয় ব্যতিক্রমী এই ডেমু ট্রেন। ট্রেনগুলোর সামনে-পেছনে দুই দিকেই আছে ইঞ্জিন। স্বল্প দূরত্বে দ্রুত চলাচলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রেনগুলো রেলওয়েতে সংযোজন করা হয়।
কেনার সময় চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি ছিল টানা ২০-২৫ বছর ব্যবহার করা যাবে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই সেট ট্রেন দিয়ে এর যাত্রা শুরু করে।
এরপর ঢাকা-টঙ্গী, ঢাকা-জয়দেবপুর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, সিলেট-আখাউড়া, কমলাপুর-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা, নোয়াখালী-লাকসাম, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট, পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে এবং সর্বশেষ চট্টগ্রাম-বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম-দোহাজারী বাকি ট্রেনগুলো চালু হয়। আমদানির পর পূর্বাঞ্চলে ১৮ সেট ট্রেন এবং বাকি দুই সেট পশ্চিমাঞ্চলে বরাদ্দ দেয়া হয়।
কিন্তু ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করার পরপরই যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। এরপর থেকে নানা যান্ত্রিক ত্রুটি লেগেই ছিল ২০ সেট ট্রেনে। চলাচল অযোগ্য এসব ট্রেনে আয়ের চেয়ে মেরামত খাতে ব্যয় বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ২০১৯ সাল থেকে ডেমু ট্রেনে যাত্রী পরিবহন সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের পাহাড়তলী কর্মব্যবস্থাপক (ডিজেল) এহতেসাম মো. শফিক জানান, চীন থেকে আমদানি করা ট্রেনগুলো মূলত ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বের যোগাযোগ সুবিধার জন্য উপযোগী। কিন্তু বেশ কিছু অজানা কারণে এবং হঠকারিতায় এসব ট্রেন ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বেও নিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ। মূলত এ কারণেই ট্রেনগুলো অল্পদিনে বিকল হয়ে পড়ে।
তাছাড়া দক্ষ লোকবল সংকটের কারনে ডেমু ট্রেনগুলো মেরামত ও অপারেটিং করা যাচ্ছেনা এবং পুরো ট্রেনে বিদেশী সফটওয়্যার থাকায় মেরামত করেও সুবিধা করতে পারছে না দেশের প্রকৌশলীরা। তাই বেশিরভাগ ডেমুর এখন মুমূর্ষু অবস্থায় ওয়ার্কশপে।
এ বিষয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক আফজাল হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ট্রেনগুলো আর সচল করা সম্ভব নয়, তাই নিলামে বিক্রির পরিকল্পনা চলছে। তিনি বলেন, ‘যা আর চালানো সম্ভব নয়, তা অকেজো ঘোষণা করে নিয়ম অনুযায়ী বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেএন/পিআর