চট্টগ্রামের পোশাকখাতের অন্যতম শিল্পগ্রুপ সাদ মুসা গ্রুপের এমডি মোহাম্মদ মহসিনকে চেক প্রত্যাখ্যান (ডিজঅনার) মামলায় অর্থদণ্ড ও ৫ বছরের কারাদন্ডের আদেশ দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
গতকাল চট্টগ্রামের মহানগর দ্বিতীয় দায়রা জজ মোহাম্মদ হাসানের আদালতে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল) আগ্রাবাদ শাখার করা মামলার শুনানিতে এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালত তাকে প্রত্যেক চেক প্রত্যাখ্যান মামলায় এক বছর করে মোট ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। পাশাপাশি তাকে চেকের সমপরিমাণ ৫৫ কোটি ৯৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
জামিন শুনানির সময় চট্টগ্রামের পোশাক খাতের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মহসিন কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন। পরে আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
আদালত সূত্র জানায়, ন্যাশনাল ব্যাংকের (এনবিএল) আগ্রাবাদ শাখার পক্ষ থেকে পাঁচটি চেক প্রত্যাখ্যান মামলা করা হয় ২০২০ ও ২০২২ সালে। পাঁচটি মামলায় মোট টাকার পাওনা দাবির পরিমাণ ছিল ৫৫ কোটি ৯৪ লাখ ৭৫ হাজার ৮০০ টাকা।
এই ৫ মামলার প্রতিটিতে এক বছর করে মোট ৫ বছর কারাদন্ড দেওয়া হয় তাঁকে। এসব মামলায় মহসিনের স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান শামীমা নারগিছকেও আসামি করা হয়েছে।
এ ছাড়া তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার মোহাম্মদ মহসিন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।
মহানগর দ্বিতীয় দায়রা যুগ্ম জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ রাকিব বলেন, ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মহসিনের বিরুদ্ধে ২০২০ ও ২০২২ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক মোট ৫টি চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা করেছিল। এসব মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গতকাল চট্টগ্রামের মহানগর দ্বিতীয় দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ হাসানের আদালতে ন্যাশনাল ব্যাংকের করা মামলার শুনানিতে আদালত তাকে এক বছর করে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও চেকের সমপরিমাণ জরিমানা করে একটি রায় ঘোষণা করে। এ রায় ঘোষণার সময় তিনি আদালতে হাজির ছিলেন। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির একটি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে বাবা ও চাচার নামের অংশ নিয়ে মোহাম্মদ মহসিন গড়ে তোলেন ‘সাদ মুসা গ্রুপ’। তিনি সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের একজন। যদিও বর্তমানে এই পদে নেই তিনি। মোহাম্মদ মহসিন বিভিন্ন সময় ভুয়া কাগজ পত্র তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন।
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রপ্তানির জন্য একাধিকবার সিআইপি খেতাবপ্রাপ্ত চট্টগ্রামের পোশাক খাতের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মহসিন পোশাক খাতের একাধিক প্রতিষ্ঠান ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে তুলেন সাদ মুসা গ্রুপ।
এসব কোম্পানিগুলো আয় দিয়ে বাড়িয়েছেন অন্যান্য ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকও হয়েছেন।
তবে মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগ, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত. ফান্ড ব্যবস্থাপনার অভাব, করপোরেট সংস্কৃতি চর্চার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ডুবেছে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবসায়।
এ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সাদ মুসা হোমটেক্স অ্যান্ড ক্লর্থিং লিমিটেড, মাহমুদ সাজিদ কটনস লিমিটেড, এমদাদ এতিমিয়া স্পিনিং মিলস লিমিটেড এবং রোকেয়া স্পিনিং মিলস লিমিটেড ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখায় ঋণ খেলাপি হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকে এ ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন এসব প্রতিষ্ঠানের নামে নেয়া মোট এক হাজার ১৮৫ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে আছে।
এরমধ্যে সাদ মুসা হোমটেক্স অ্যান্ড ক্লর্থিং লিমিটেডের এক হাজার ৮৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা, মাহমুদ সাজিদ কটনস লিমিটেডের ১৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, এমদাদ এতিমিয়া স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ৪২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা এবং রোকেয়া স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
এসব বকেয়া খেলাপি পাওনা আদায়ে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়। পাশাপাশি চেক প্রত্যাখানের একাধিক মামলাও করা হয়। এসব মামলা চলমান রয়েছে।
গতকাল চট্টগ্রামের মহানগর দ্বিতীয় দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ হাসান শুনানিতে তাকে কারাদণ্ড ও ৫৫ কোটি টাকা জরিমানা করে একটি রায় ঘোষণা করেন। এ রায় শুনার পর তিনি আদালত হাজত থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হোন।
ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সাদ-মুসা গ্রুপের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ১৮৫ কোটি টাকার মতো পাওনা রয়েছে। এগুলো আদায়ে বেশ কয়েকবার তাঁকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে।
ঋণ আদায়ে গত ৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের বায়েজিদ কুলগাঁও এলাকায় সাদ-মুসা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। সেখানে ‘ঋণ আদায়ে অবস্থান কর্মসূচি’ ব্যানার নিয়ে অবস্থান নেন তাঁরা।
এর আগে গত বছরের ২৪ এপ্রিল সাদ-মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন ও তাঁর স্ত্রী শামিমা নারগিছের বিরুদ্ধে ঋণখেলাপির মামলায় দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত।
জানা গেছে, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাদ-মুসা গ্রুপের তিন হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি রয়েছে। এগুলো পরিশোধের জন্য সুদ মওকুফ ও দুই দফা পুনঃ তফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়; কিন্তু তাঁরা সে সুযোগ গ্রহণ করেননি।
খেলাপি ঋণ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পোশাক খাতের শিল্প গ্রুপ সাদ মুসা গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠান আমাদের ঋণ খেলাপি। ঋণ আদায়ে চেক প্রত্যাখ্যানের একাধিক মামলা করা হয়েছে।
এ গ্রুপের যা অবস্থা তা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো অনেক কঠিন হবে। সবগুলো ব্যাংক ঝামেলা পড়ছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলাও করেছে।
সাদ মুসা গ্রুপ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানায়, ১৯৮২ সালে পোশাক খাত দিয়ে ব্যবসা শুরু করে সাদ মুসা গ্রুপ। চট্টগ্রামের পোশাক খাতের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মহসিন চট্টগ্রাম ফেব্রিক্স বোর্ড লিমিটেড, সাদ মুসা ফেব্রিক্স লিমিটেড, এম এ রহমান ডায়িং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, সাদ মুসা হোম টেক্সটাইল অ্যান্ড ক্লথিং লিমিটেড, দেশ কম্পিউটার, মার্স অটোমোবাইলস, সাদ মুসা হাউজিং কমপ্লেক্স লিমিটেড, হাসনি বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, আল মুস্তফা ইন্ডস্ট্রিজ লিমিটেড, আহমদি অয়েল মিলস লিমিটেড, ক্রিসেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রোকেয়া স্পিনিং মিলস লিমিটেড, এমদাদ এতিমিয়া স্পিনিং মিলস লিমিটেড, সুলতান হাবিবা ফেব্রিক্স লিমিটেড, মাহমুদ সাজিদ কটন মিলস লিমিটেড, সায়মা সামিরা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, কর্ণফুলী জুট ট্রেডিং একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি গ্র¤œপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি ফ্যাব্রিক্স, স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং, প্রিন্টিং ও ফিনিশিং কারখানা চালুর ধারাবাহিতকায় আনোয়ারায় স্থাপন করেন রপ্তানিমুখী শিল্প পার্ক।
তবে শুরু থেকে নানা জটিলতার কারণে সংকটে পড়ে গ্রুপটি এখন পর্যন্ত শিল্পপার্কটি চালু করতে পারেনি, যা পুরো গ্রুপ ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বৃহৎ এ গ্রুপের ব্যবসায় পরিচালনার জন্য দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো ঋণ সুবিধা নেন। এর মধ্যে অধিকাংশ ব্যাংকে খেলাপি হয়ে পড়েছেন। এ ব্যবসায়ীকে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের পরিচালক পদ ছাড়তে হয়।
এছাড়া কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নামে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার, কর ফাঁকি ও আয়কর রিটার্নে বিদেশে বিনিয়োগের তথ্য গোপনের অভিযোগও রয়েছে।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ গত বছরের ৫ নভেম্বর উত্তরা ব্যাংক লালদিঘি শাখার ১০৫ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৮১৪ টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের মামলায় সাদ মুসা গ্রুপের এমডি মোহাম্মদ মহসিন ও তার স্ত্রী শামীমা নারগিছ চৌধুরীকে ৫ মাসের দেওয়ানি আটকাদেশ দেয় চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। একইসাথে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
জেএন/পিআর