বীর- শব্দটি শুনলেই মনের কোণে যেন এক অদৃশ্য শক্তির ছবি চলে আসে। এ শক্তির উৎস কোথায় তা জানতে অবশ্য দূরে যেতে হবে না, হাতের কাছে থাকা বাংলা একাডেমির অভিধান দেখলেই হবে। যেখানে বীরের অর্থ হিসেবে লেখা আছে- নির্ভীক ও বলবান, তেজস্বী কিংবা শক্তিমান পুরুষ।
বাংলা একাডেমির এমন অর্থ সত্যিকার অর্থেই সার্থক করেছেন বীর বাহাদুর উশৈসিং। সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এ পাহাড়ি সময়ের সঙ্গে লড়াই করে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ।
১৯৬০ সালের ১০ জানুয়ারি পার্বত্যাঞ্চল বান্দরবানে জন্মগ্রহণ করেন বীর। তাঁর মায়ের নাম মা চয়ই, বাবা লালমোহন বাহাদুর।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পড়ালেখায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। ১৯৭৬ সালে বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাস করেন এসএসসি। এরপর তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে এবং পরে বান্দরবান সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নেন স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
পড়ালেখার পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনেও বেশ সফল বীর। এক সময়ের এ ফুটবল খেলোয়াড় দীর্ঘদিন ধরে দক্ষতার সঙ্গে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল টুর্নামেন্টের ম্যাচ পরিচালনা করেন। ১৯৯৭ সালে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল কোয়ালিফায়িং রাউন্ডে অংশ নিতে তিনি মালয়েশিয়া যান এবং বাংলাদেশ ফুটবল দলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ ফুটবল রেফারি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিক ২০০০-এ বাংলাদেশ দলের চিফ অব দ্য মিশনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ছিলেন বান্দরবান ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক। পরে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি পালন করেন বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সহসভাপতির দায়িত্বও।
২০০২ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের হুইপ নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালটা নিশ্চিত বীরের জীবনে স্মরণীয় এক বছর। ওই বছরই তিনি নতুন এক জীবনে পা বাড়ান। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মে হলা প্রুর সঙ্গে। তবে শুধু এজন্যই এটিকে স্মরণীয় বছর বলছি না। সেই বছরই যে বান্দরবান ৩০০ নম্বর আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বীর!
এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সাংসদে ডাবল হ্যাট্রিক করার পথে জয়ী হয়েছেন ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে।
সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জয়ী হন বিশাল ব্যবধানে। তাঁর ১ লাখ ৪২ হাজার ২২৩ ভোটের বিপরীতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী সাচিং প্রু জেরী পান মাত্র ৫৮ হাজার ৪৭ ভোট।
অবশ্য এবার বীরের নির্বাচনি প্রচারেও চমক ছিল। মহান বিজয় দিবসে অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর তিনি প্রচারণা শুরু করেন নৌকায় চড়ে। এ দিন তিনি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলা থেকে প্রচারণা শুরু করেন।
বীরের জন্য প্রচারণা করেন দলনেত্রীও! ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডির সুধাসদন থেকে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বান্দরবান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, আগামীতে আরো গড়ে উঠবে এবং শিক্ষার মান বাড়বে। সড়ক যোগাযোগ ও পর্যটন শিল্পের বিকাশে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে আগামী নির্বাচনে আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন। আমি নৌকায় ভোট চাই।’
ওই ভিডিও কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন বীরও। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ফের ৩০০ নম্বর সংসদীয় আসনটি উপহার দেওয়ার আশ্বাস দেন। সেটি যে শুধু আশ্বাস ছিল না সময়েই সেটি প্রমাণ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা সবসময় বীরদের যথাযথ সম্মান দেন। বীরের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বর্ণিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ‘বীর’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় প্রথম স্থান পান ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি। সেবার তাঁকে করা হয় প্রতিমন্ত্রী। আর এর ঠিক পাঁচ বছর পর (৭ জানুয়ারি, ২০১৯) এবার একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁকে।
বীরের আগে পার্বত্যাঞ্চল থেকে একজনই হয়েছিলেন পূর্ণ মন্ত্রী। তাও দুই দশক আগে। ১৯৯৮ সালে খাগড়াছড়ির প্রয়াত সাংসদ কল্পরঞ্জন চাকমা পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
এর আগে ১৯৯৮ সালে উপমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রথমবারের মতো এবং ২০০৮ সালে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় দ্বিতীয়বারের মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙামাটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান বীর। নবম জাতীয় সংসদের সংসদ কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি। ছিলেন ওই সংসদের একজন প্যানেল স্পিকারও। ২০১৩ সালের ২২ জুলাই তিনি খণ্ডকালীন সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে পুরো বান্দরবানকেই বদলে দিয়েছেন বীর। আর গত পাঁচ বছর প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন বান্দরবানকে ভাসিয়েছেন উন্নয়নে। এ সময়ে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে। এর চেয়ে বড় ব্যাপার, তাঁর সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। উন্নত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। নতুন ব্রিজ-কালভার্ট-সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি বিশাল পরিবর্তন এসেছে স্বাস্থ্যসেবা ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থায়।
বলা হয়, সকাল দেখলেই বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে। বীরের এই উন্নয়নের জোয়ার যে বহমান থাকবে তা অনুমেয়। কারণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের পর মুহূর্তের জন্যও তিনি উন্নয়নের জোয়ার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেননি। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হলো, আর ১ জানুয়ারি তিনি হাজির শিক্ষার্থীদের পাশে। বছরের প্রথম দিনটিতেই তিনি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিলেন নতুন বই।
জেলা সদরের রাজার মাঠে কেন্দ্রীয়ভাবে আয়োজিত বই উৎসবের বিশাল আয়োজন করে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ। আর সেই আয়োজনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার পাশাপাশি মুখে তুলে দেন মিষ্টি। এ দিন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের মধ্যে তাদের নিজ নিজ ভাষায় মুদ্রিত বইসহ জেলার ৪৩২টি প্রাথমিক স্কুল ও মাদ্রাসায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৬০৭ সেট বই বিতরণ করা হয়। এছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৫২ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণ করা হয় ৬ লাখ ৯০ হাজার ৫৭৫টি বই।
অবশ্য শিক্ষানুরাগী হিসেবে বীরের খ্যাতিটা অনেক আগের। ২০১০ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য মনোনীত হন এবং এখনো এ পদে আছেন।
বৃক্ষরোপণেও বিশেষ অবদানে তিনি জাতীয়ভাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তিত্ব। ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার নিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে ফ্রান্স যান। আবার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনে তিনি নিজেকে সঁপে দেন। ওইসময়ে তাঁর অনন্য ভূমিকা সর্বমহলে বেশ প্রশংসিত হয়।
বীরের ব্যক্তিগত জীবনটাও বেশ সুখের। তাঁর সব যুদ্ধেই পাশে থাকেন স্ত্রী মে হলা প্রু। যাদের সংসারে আছে মেধাবী দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে।
একজন জহুরি চিনতে পারেন কোনটি আসল হীরা। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে অদ্বিতীয়। দুর্গম পাহাড় থেকে তিনি ঠিকই বেছে নিয়েছেন আসল হীরা।
বীর বরাবরই চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন। তাঁর এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার দক্ষতার কারণেই পার্বত্যবাসীর প্রত্যাশাটাও এখন অনেক বেশি।
বৈচিত্র্যে ভরপুর আমাদের তিন পার্বত্যাঞ্চল- রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান। পর্যটনে অমিত সম্ভাবনা আছে এই তিন জেলার। পর্যটনে বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক পার্বত্যাঞ্চল- বীরের কাছে পার্বত্যবাসীর এটিই এখন প্রধান চাওয়া।
বীর বাহাদুর উশৈসিং একজন প্রকৃত বীর। পরাজয় যাঁকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। অপরাজেয় এই বীরের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক- একজন সাধারণ সংবাদকর্মী হিসেবে এটিই আমার প্রত্যাশা।