চট্টগ্রাম নগরীর এস এস খালেদ রোড (আসকার দীঘির উত্তর পাড়) এলাকায় সিডিএর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা উপেক্ষা করে পাহাড় কেটে ৯২টি পরিবারের জন্য তিনটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছিলেন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান স্বপ্নীল ফ্যামিলি ওনার্স।
অভিযোগ রয়েছে, পাহাড় না কেটে ৩০ কাঠার জমিতে স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ জায়গা খালি রেখে ভবন নির্মাণের শর্তে সিডিএ’র কাছ থেকে অনুমোদন নিলেও এসব শর্ত উপেক্ষা করা হয়েছে এবং সড়ক থেকে দেখা না যাওয়ার জন্য উঁচু টিনের বেস্টনি দিয়ে ভেতরে পাহাড় কাটে পুরো জায়গাজুড়েই ভবনের নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি।
স্থানীয়দের কাছ থেকে এমন অভিযোগ পেয়ে গত ১৮ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার চসিকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতি সর্ববিদ্যার নের্তৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হয়। তবে অভিযানের কথা জানতে পেরে ওই প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সাইট ইঞ্জিনিয়ার পালিয়ে যান।
তাছাড়া ঘটনাস্থলে মালিকপক্ষের কাউকে না পাওয়ায় ওইদিন মামলা/জরিমানা করা না হলেও পাহাড় কাটার বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানায় চসিক।
পরে সিডিএ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের বিশেষ টিম সরেজমিনে পরিদর্শণে গিয়ে পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতি করার প্রমান পায়। তাছাড়া নির্মাণে শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেন সিডিএ।
তবে সিডিএর এ নির্দেশনা মানতে নারাজ স্বপ্নীল ফ্যামিলি ওনার্স। নির্দেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি। তাদের সে আশার গুড়ে বালি।
গত রবিবার ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটির আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। ফলে শাস্তিস্বরুপ গতকাল সোমবার সকাল ১১টার দিকে পাহাড় কেটে অবৈধভাবে নির্মাণাধীন বহুতল ভবনটি ভাঙার কাজ শুরু করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
সিডিএ চেয়ারম্যান মো. নুরুল করিমের উপস্থিতিতে অবৈধ ভবনটি ভাঙার কাজ পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ) মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম।
অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনার বিরুদ্ধে পরিচালিত উচ্ছেদ অভিযানে উপস্থিত ছিলেন চউকের আইন উপদেষ্টা এডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্সান, চউকের সচিব, প্রকৌশলীবৃন্দ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
এবিষয়ে চউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম বলেন, “নগর পরিকল্পনার বাইরে গড়ে ওঠা যেকোনো অবৈধ স্থাপনা, বিশেষ করে পাহাড় কেটে নির্মিত ভবন-শহরের পরিবেশ ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। বর্ষায় এসব এলাকায় ভূমিধ্বস ও প্রাণহানির ঝুঁকি থাকে। তাই এসব স্থাপনার বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি।
ভবন ভাঙার বিষয়ে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ) মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, পাহাড় না কাটাসহ ৮৭টি শর্তে ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল সিডিএর ইমারত নির্মাণ কমিটির কাছ থেকে তিনটি বেজমেন্ট ও ১৪ তলা ভবনের অনুমোদন নেয় স্বপ্নের ফ্যামিলি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
তবে শর্তের তোয়াক্কা না করেই পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি। পরে সিডিএর টিম নির্মাণাধীন ভবনের কাজ পরিদর্শণে এলে শর্তভঙ্গের প্রমাণ মেলে।
এসময় সিডিএ’র পক্ষ নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিলে তারা উচ্চ আদালতে আবেদন করে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে।
রবিবার আদালত তাদের আবেদন খারিজ করে দিলে সোমবার সকাল থেকে অবৈধ ভবনটি ভাঙার কাজ শুরু করে সিডিএ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে স্বপ্নীল ফ্যামিলি ওনার্সের খোকন এর ০১৭——৪৭ নাম্বার এবং সজলের ০১৬——৩৩ নাম্বারে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা ফোন রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, জমিটি বাড়ি হিসেবে লিপিবদ্ধ করে নথি সিডিএতে জমা দেওয়া হয়। তবে নগরীর আসকার দীঘির পাড় এস এস খালেদ রোডে এটি গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের পাহাড় বলে পরিচিত। ওই পাহাড়ের ঢালের সর্বোচ্চ চূড়া ১২৭ ফুট উঁচু। বাস্তবে পাহাড় হলেও সরকারের রেকর্ডে বাড়ি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বাড়ি হিসেবেই ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি ৯২ জনের নামে জমিটির নামজারি হয়। অথচ ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে এবং ২০১০ সালের সংশোধিত আইন অনুসারে এটি পাহাড়। আর এই আইন অনুসারে পাহাড় কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এবিষয়ে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ)র মহাসচিব এডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্সান বলেন, “পাহাড় কাটা একটি ফৌজদারি অপরাধ। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ধারা ৬(খ) অনুযায়ী, পাহাড় কাটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর জন্য জরিমানা ও কারাদণ্ড উভয় দণ্ডই প্রযোজ্য হতে পারে।
তাছাড়া, বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ২৬৮ অনুযায়ী, জনসাধারণের জন্য ক্ষতিকর পরিবেশ সৃষ্টিকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।’’
চউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম বলেন, “উচ্ছেদ অভিযান চলমান থাকবে। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়া নির্মাণকাজ পরিচালনা করছে কিংবা দৃশ্যমান পাহাড় কেটে অবৈধ স্থাপনা গড়ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভবিষ্যতে এসব এলাকায় ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থা স্থাপন করে অবৈধ কার্যক্রম প্রতিরোধ করা হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় জনগণকেও পাশে থাকার আহ্বান জানান তিনি।
জেএন/পিআর