মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় এবার প্রায় সব বোর্ডেই ফল বিপর্যয় হয়েছে। এবার পাসের হারে সবচেয়ে বড় ধস নেমেছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে।
গত এক দশকের মধ্যে এ বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিকে সার্বিক পাশের হারে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়েছে এবার। ফলাফল পর্যালোচনা করে বেশ কয়েকটি কারণ দেখছেন পরীক্ষা সংশ্লিষ্টরা। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় প্রভাব গণিতে উত্তীর্ণ হতে না পারা এবং গুণগত মান ধরে রাখা।
এদিকে বিগত সরকারের সময়ে যেভাবে খাতা মূল্যায়ন করা হত, তার বদলে এবার ‘যার যা প্রাপ্য তাই দেওয়ায়’ পাসের হারে প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজিতেও খারাপ করেছে, তবে গণিতের মতো নয়। শুধু চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডেই ফল বিপর্যয় হয়েছে তা কিন্তু নয়।
দেশের ১১ শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ২৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গণিতে ফেল করেছে। অপরদিকে ইংরেজিতে ফেল করেছে ১৩ শতাংশ। দুই বিষয়েই ফেলের হার গত কয়েক বছরের চেয়ে বেশি।
ফল বিশ্লেষণে পাশের হার কমে যাওয়ার পেছনে আরও দুটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এর একটি হচ্ছে, মানবিক বিভাগে পাশের হার মাত্র ৫৪ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের পাশের হার মাত্র ৬৬ শতাংশ।
এ দুই বিভাগের ফল সার্বিক পাশের হারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এবার মানবিকে প্রায় ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। আর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে প্রায় ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডেও এবার মানবিক বিভাগে গত বছরের তুলনায় ১৮ দশমিক ২১ শতাংশীয় পয়েন্ট কম শিক্ষার্থী পাস করেছে। এ বিভাগে পাসের হার ৫৫ দশমিক ০২ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।
তাছাড়া ব্যবসায় শিক্ষা শাখাতেও ফলাফল আগের বছরগুলোর তুলনায় খারাপ হয়েছে। ২০২৪ সালে এ শাখা থেকে ৮৪ দশমিক ১১ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করলেও এবার তা এ হার ৭৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
এ বছর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করেছেন ৯২ দশমিক ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী, যা ২০২৪ সালে ছিল ৯৪ দশমিক ৫২শতাংশ।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের তথ্য বলছে, সব বিভাগের শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক সাধারণ গণিতে পাস করেছেন শতকরা ৮১ দশমিক ৫৩ জন, যা বিষয়ভিত্তিক পাসের সর্বনিম্ন হার। এরপর রয়েছে ইংরেজিতে ৮৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। উচ্চতর গণিতে পাসের হার ৯৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষায় পাসের হার বাংলায় ৯৮ দশমিক ৬২, সাধারণ বিজ্ঞানে ৯২ দশমিক ৭৮, রসায়নে ৯৭ দশমিক ২৯, পদার্থ বিদ্যায় ৯৭ দশমিক ৬১ শতাংশ, জীব বিজ্ঞানে ৯৮ দশমিক ৭৬, হিসাব বিজ্ঞানে ৯৫ দশমিক ৫৬, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিংয়ে ৯৬ দশমিক ০২ শতাংশ, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিতি বিষয়ে ৯৮ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং ব্যবসায় উদ্যোগে ৯৯ দশমিক ৯১ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে চলা পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া বা পাশের হার বাড়ানো থেকে বেরিয়ে এসছে অন্তর্বর্তী সরকার।
শিক্ষার্থীদের অপ্রাসঙ্গিক ও ভুল উত্তরে নম্বর না দেওয়া এবং যথাযথ মূল্যায়নের নির্দেশনা ছিল বোর্ড থেকে। এতে ফলাফলে প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী বলেন, এবারের ফলাফলে গুণগত মান দেখা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যা লিখেছে, সেটির ভিত্তিতে খাতা মূল্যায়ন হয়েছে। আগের বছরগুলোতে পরীক্ষার্থীদের ‘গ্রেস নম্বর’ নিয়ে গ্রেড বাড়িয়ে দেওয়া হত। কিন্তু এবার সেটি হয়নি।
তিনি বলেন, পরীক্ষার ফলাফল খারাপের পেছনে আর একটি কারণ হতে পারে পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটা।
২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদানে ব্যাঘাত হয়েছে। সে কারণেও ফলাফলে একটা সার্বিক প্রভাব পড়তে পারে।
এদিকে পাশের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার পেছনে পরীক্ষার হলে এবং খাতা মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ি’কে বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা। শিক্ষার প্রকৃত মান যাচাই ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে বাস্তবসম্মত করতে এই কড়াকড়ি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় দশক ধরে খাতা মূল্যায়নে উদারনীতির কারণে দেশে পাশের হার এবং জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল।
২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর থেকে খাতা মূল্যায়নে উদার হওয়ার চর্চা ব্যাপকতা পায়।
পরীক্ষকদের মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়, খাতায় কিছু লেখা থাকলেই যেন নম্বর দেওয়া হয়। এতে পাশের হার ও জিপিএ-৫-এর হার কমে। শিক্ষার সার্বিক মান নিয়ে দেশবিদেশে প্রশ্ন ওঠে।
এ বিষয়ে বুধবার শিক্ষা উপদেষ্টা ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেছেন, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে শিক্ষার্থীদের মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয়েছে।
১৬ বছরে যে সরকার ছিল, তাদের আমলে সরকারের সাফল্য দেখানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়িয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ফল প্রকাশ করা হতো।
এমনকি সে ফল প্রকাশ নিয়ে একধরনের ফটোসেশনের আয়োজন ছিল সরকারপ্রধানের। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার এটাকে বাহুল্য মনে করছে।
এটা থেকে সরে এসে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতার প্রকৃত মূল্যায়নে শিক্ষা বোর্ডগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রেজাল্ট প্রকাশের কারণে অতীতে ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত মূল্যায়ন না হওয়ায় তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।
পরীক্ষায় পাশের হার বাড়ানোর পাশাপাশি জিপিএ-৫-এর সংখ্যাও বেশি পরিমাণে দেখানো হয়েছে। আমরা এবার জিপিএ-৫ নয়, প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন দেখতে যাচ্ছি।
বৃহস্পতিবার রেজাল্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা তাদের সেই মেধার যথাযথ মূল্যায়ন দেখতে পাবে। আগামী দিনেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত এসএসসি, মাদ্রাসা বোর্ডের দাখিল এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি ও দাখিলসহ (ভোকেশনাল) ১১ বোর্ডের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এতে সর্বমোট পাশের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ হার গত বছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম।
১৫ বছরের মধ্যেও এবারের পাশের হার সর্বনিম্ন শুধু পাশই নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে। এবার সর্বমোট ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। গত বছর পেয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। সেই হিসাবে জিপিএ-৫ কমেছে ৪৩ হাজার ৯৭টি।
তবে এবারও ছাত্রীরা বেশ ভালো করেছে। ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের পাশের হার প্রায় ৪ শতাংশ বেশি। ছাত্রদের চেয়ে ৮ হাজার ২০০ বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে ।
জেএন/পিআর