দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্ক শেষে এ পর্যায়ে সংলাপের যতি টেনে রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক ১৯টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছার কথা বলেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ; যেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন দলের কাছ থেকে ১০টিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ এসেছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় দফার সংলাপের শেষ দিনের বৈঠক শেষে এ কথা বলেন আলী রিয়াজ।
আলী রিয়াজ বলেন, “দীর্ঘ আলোচনা, মতপার্থক্য ও আলোচনা শেষে জাতীয় ঐক্যমত কমিশন মোট ১৯টি মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছে।
তবে কিছু বিষয়ে এখনও ভিন্নমত ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্ন মত) থেকে গেছে, যা পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হবে।”
রাষ্ট্র সংস্কারে ঐকমত্য কমিশন গত ৩ জুন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ আলোচনা শুরু করে, যেটির দ্বিতীয় দফায় ২৩তম দিনের আলোচনা শেষ হয় বৃহস্পতিবার।
এর আগে প্রথম দফার আলোচনায় ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য পৌঁছার কথা জানিয়েছে কমিশন।
প্রথম পর্বে আলোচনা হওয়া ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৬২টির বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ার এ তালিকা বুধবার আলোচনায় অংশ নেওয়া দলগুলোকে দেয় কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। দলগুলোর মধ্যে ৩৩টি তাদের মতামত দেয়।
এরপর ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশনের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ের সংলাপ শেষ করে কমিশন।
বৃহস্পতিবার শেষ দিনের দীর্ঘ বৈঠকে সংবিধানের বিদ্যমান চার মূলনীতি বাদ দেওয়া নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বৈঠক ‘বর্জন’করে বাম ধারার চারটি দল। দিনের আলোচনার সময় বেশ কয়েকটি বিষয়ে নিয়ে বৈঠকে উত্তেজনাও তৈরি হয়।
এসব ছাপিয়ে শেষ দিনের বৈঠকের ইতি টেনে রাত সোয়া ১০টায় বিফ্রিংয়ে আসেন ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি আলী রীয়াজ।
এতে মৌলিক বিষয়ের সংস্কার বাস্তবায়নে দলগুলোর আন্তরিকতা থাকার তুলে ধরে তিনি বলেন, “পাশাপাশি একটা প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ কী হবে? সেগুলো নিয়েও বিভিন্নভাবে আলোচনা হবে।
সেই আলোচনা অব্যাহত রাখার জন্য দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যমত কমিশনকে অনুরোধ করা হয়েছে।
”জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা মনে করি যে যেকোনো প্রক্রিয়াতে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ পদ্ধতি চিহ্নিত করতে হবে।
সেই প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ আছে, আন্তরিকতা আছে। আমরা অনুরোধ করেছি যে তারা নিজেদের মধ্যেও আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখুক।”
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে পরর্বর্তী সময়ে ‘অনুঘটকের’ দায়িত্ব পালন করার আগ্রহ তুলে ধরে তিনি বলেন, “বাইরেও যতটুকু প্রয়োজন অর্থাৎ সকলকে সমন্বিত করে সকলের সাথে এ বিষয়ে পদ্ধতি নিয়ে আলাপ শিগগিরই একটি সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত সকল বিষয়ে জানানো হবে।”
আলোচনা শেষে বিফ্রিংয়ের সময় আলী রীয়াজের সঙ্গে কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে গত ২ জুন প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি মুহাম্মদ ইউনূস দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার উদ্বোধন করেন। ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে ২৩ দিনের আলোচনা হয়।
ঐকমত্য যেসব বিষয়ে
১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন
২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব নির্ধারণ
৩. নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ
৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান
৫. উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ
৬. পর্যায়ক্রমে উপজেলায় নিম্ন আদালত স্থানান্তর
৭. জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা
৮. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ
৯. নির্বাচন কমিশন গঠন পদ্ধতি
১০. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান সংস্কার
১১. প্রধানমন্ত্রী পদে ১০ বছরের বেশি নয়
১২. স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন
১৩. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব
১৪.সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন
১৫. সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত;
১৬. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি;
১৭. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব;
১৮. রাষ্ট্রের মূলনীতি।
১৯. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ পদ্ধতি
নোট অব ডিসেন্ট যেসব বিষয়ে
ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর ’ভিন্ন মতের’ (নোট অব ডিসেন্ট) এর কথা তুলে ধরে শেষ দিনের বৈঠক শেষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
আলী রীয়াজ বলেন, ”নারীদের আসন বৃদ্ধির প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট এসেছে৷
”রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিষয়ে আজ (বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশ জাসদ, বাসদ-মার্কসবাদী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি নোট অব ডিসেন্ট প্রদানসহ সভা বর্জন করে। এছাড়া এ বিষয়ে গণফোরামের প্রতিনিধি এই বিষয়ে ভিন্নমত প্রদান করলেও সভা বর্জন করেননি।“
কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টসহ ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া’ সংস্কারগুলো হল-
১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন
২. নারী প্রতিনিধিত্ব
৩. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ ও সুপ্রীম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ
৪. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা
৫. সরকারি কর্মকমিশন, দুদক, সিঅ্যান্ডএজি এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে সংযোজন করা
৬. উচ্চকক্ষ গঠন
৭. রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি
৮. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব
৯. তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উত্থাপিত সমন্বিত প্রস্তাবের ৮, ৯, ১১ এবং ১২ ক্রমিক নম্বরের প্রস্তাবসমূহ
১০. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি