জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া পরিবর্তন করা হবে। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের আপত্তি থাকায় অঙ্গীকারনামা সংশোধন করা হচ্ছে। পরে তা আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। আগামী সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফার সংলাপ শুরু হতে পারে।
গতকাল বুধবার সংসদে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। কী কী পরিবর্তন আনা হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, পর্যালোচনার পর আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে তা ঠিক হতে পারে। প্রাথমিকভাবে কয়েকটি দলের সঙ্গে আগামী সপ্তাহে বৈঠক হবে। পরে সব দলকে একসঙ্গে ডাকা হবে বৈঠকে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, শুধু অঙ্গীকারনামা নয়, পটভূমিও পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। সনদের আইনি ও সাংবিধানিক দিকও বিবেচনায় রয়েছে।
সংস্কারের সুপারিশের মতো সনদেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কমিশন সিদ্ধান্ত দেবে কিনা– এ প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেন, যেসব সংস্কারের পক্ষে তিন-চতুর্থাংশ দল ছিল, সেগুলোর পক্ষেই সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। সনদের ক্ষেত্রেও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্ন আসবে। তবে সংখ্যাই শেষ কথা নয়। কোন দলের রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা, তাও বিবেচনায় নিতে হবে।
গত ১৬ আগস্ট ৩০ রাজনৈতিক দল ও জোটকে সনদের খসড়া দেয় কমিশন। এতে আট দফা অঙ্গীকার রয়েছে। অঙ্গীকার অংশে বলা হয়েছে, সংবিধান ও আইনের ওপরে প্রাধান্য পাবে সনদ। তা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। সনদের ব্যাখ্যা দেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের থাকবে। যেসব সংস্কার বাস্তবায়নযোগ্য, তা সরকার নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন করবে।
বিএনপি এই চারটি অঙ্গীকারের বিরোধী। দলটি মতামতে জানিয়েছে, সংবিধান সর্বোচ্চ আইন, এর ওপরে সনদের প্রাধান্য থাকতে পারে না। আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধ হলে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। সনদ রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হওয়ায় আইনি ভিত্তির প্রয়োজন নেই। সংবিধান সংশোধন করতে হবে, এমন সংস্কার আগামী সংসদে হবে।
ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করা জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান বিএনপির বিপরীতে। দলটি সংবিধানের ওপরে সনদের প্রাধান্য এবং আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রহিত করার পক্ষে। জামায়াতের দাবি, গণভোটে বা রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে সনদ কার্যকর করতে হবে। সনদের অধীনে নির্বাচন হবে। এনসিপি সনদকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষপাতী না হলেও দলটি সনদের অধীনে গণপরিষদ নির্বাচন এবং সেখানে সাংবিধানিক সংস্কারগুলো কার্যকরের দাবি করছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে বিশেষজ্ঞ এবং সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে গণভোট এবং বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয়নি।
এ পরিস্থিতিতে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সনদ চূড়ান্ত করে এতে রাজনৈতিক দলগুলোর সই নিশ্চিত করতে চায় কমিশন। কমিশন সদস্য বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, অঙ্গীকারের অংশে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া মতামত অনুযায়ী কিছু পরিবর্তন, পরিমার্জন করা হবে। তবে কী কী পরিবর্তন আসবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। ঠিক হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোকে সনদ পাঠানো হবে। আশা করছি, তারা সই করবে।
জুলাই সনদে লেখা আছে কী কী সংস্কার হবে। কমিশন দুই দফার সংলাপে ১৬৬ সুপারিশের মধ্যে ৮৪টির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। দ্বিতীয় দফার সংলাপে ২২ সুপারিশের ১১টিতে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) রয়েছে। এগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের মতামতে সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। পিআর পদ্ধতিতে ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনসহ ৯টি সিদ্ধান্তে বিএনপির আপত্তি রয়েছে। জানিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে এগুলো তারা বাস্তবায়ন করবে না।
সংস্কারের সুপারিশের মতো সনদের বাস্তবায়নেও দলগুলোর মতপার্থক্য থাকায় অচলাবস্থা সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে। ২৯টি দল ও জোট মতামত দিয়েছে।
কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সনদের সমন্বিত খসড়া এসব মতামতের কীভাবে ঘটানো যায়, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সনদের চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় আইনি ও নীতিগত কাঠামো গঠনের বিষয়েও আলোচনা হয়। সনদ বাস্তবায়নের সম্ভাব্য বিকল্পগুলোও বৈঠকে আলোচিত হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
জেএন/এমআর