বন্দরনগরের বাহারি পরিচয় বাণিজ্যিক রাজধানী। কিতাবের সেই গরু যার দেখা গোয়ালে মেলে না। তারপরও শত প্রতিকূলতার মধ্যে ব্যবসায়ের ‘যুদ্ধটা’ সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। প্রশাসনের কাছে তাদের চাওয়াটা খুব সামান্যই। তারা চান যৌক্তিক সহযোগিতা। তাতো মিলছেই কম, উল্টো সওয়ার হতে হচ্ছে বৈষম্যের ঘোড়ায়। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বসানো হয়েছে ওজন স্কেল। তাও মাত্র ১৩ টনের সীমা নির্ধারণ করে! বর্তমানে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের দুঃখের কারণ হয়ে উঠেছে এই ১৩ টনের ওজন স্কেল। নগরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানাচ্ছেন জয়নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মনির ফয়সাল।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বসানো ওজন স্কেলের কারণে বন্দরনগরের ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহনে গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। যে কারণে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারছেন না চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা।
অথচ দেশের অন্যান্য মহাসড়কে এ ধরনের কোনো স্কেল বসানো হয়নি। এতে দীর্ঘদিন থেকেই দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ। সাম্প্রতিক অতীতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আল্টিমেটাম, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদানসহ নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোন সমাধান মেলেনি। তাই ব্যবসায়ীরা এ বিষয়ে চাইছেন সরকারের সুদৃষ্টি। তারা চান যত দ্রুত সম্ভব এই ওজন স্কেল যেন সরিয়ে নেওয়া হয় অথবা ওজন স্কেলের সর্বোচ্চ সীমা ১৮ টন করা হোক।
জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি ও দারোগাহাটে রয়েছে দুটি ওজন স্কেল। এই ওজন স্কেল বসানোর আগে প্রতি গাড়িতে ২০ থেকে ৩০ টন মালামাল পরিবহন করা গেলেও এখন ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করা যাচ্ছে না। এতে বন্দরনগরী থেকে পণ্য পরিবহনে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে দেশের অন্যান্য স্থানের অনেক ব্যবসায়ী এখন মংলা ও নারায়ণগঞ্জের নৌপথ দিয়ে পণ্য পরিবহন করছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, এক দেশে দুই আইন কখনোই কাম্য হতে পারে না। দেশের আর কোনো মহাসড়কে এ ধরনের ওজন স্কেল না থাকায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখিন হচ্ছেন। একইসঙ্গে আমদানি-রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ীরা পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রাম বন্দরের স্থলে অন্য বন্দর ব্যবহারকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক ও খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমদ জয়নিউজকে বলেন, সারাদেশে মহাসড়ক রয়েছে ২২টি। কিন্তু সড়ক ও জনপথ বিভাগ শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৩ টন ওজন স্কেল নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আমার প্রশ্ন হলো, এটি শুধু ঢাকা-চট্টগ্রামের জন্য কেন? আইন সব সড়কের জন্য সমান হওয়া উচিত। এ প্রজ্ঞাপনের কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পরিবহন খরচের কারণে প্রত্যেক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে বন্দর থেকে এক কনটেইনার পণ্য ডেলিভারির জন্য প্রয়োজন হতো একটি গাড়ি। কিন্তু বর্তমানে এক কনটেইনার পণ্য ডেলিভারিতে লাগছে দুটি গাড়ি। এতে করে খরচের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পণ্যের দামও।
তিনি আরো বলেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ বলছে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানগুলো ১৩ টনের বেশি পণ্য বোঝাই করার কারণে রাস্তা ডেবে যাচ্ছে (ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে)। আসলেই কি রাস্তা শুধু ঢাকা-চট্টগ্রামেই ডেবে যাচ্ছে? অন্য ২১ মহাসড়কে ডেবে যাচ্ছে না? সরকারের কাছে আমাদের দাবি, ওজন স্কেল কমপক্ষে ১৮ টন নির্ধারণ করতে হবে এবং তা সব মহাসড়কের জন্য করতে হবে। যদি তা না করা হয়, সেক্ষেত্রে ১৩ টন ওজন স্কেলের আইন দেশের অন্যান্য মহাসড়কেও বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ বিষয়ে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি সোলাইমান বাদশা জয়নিউজকে বলেন, দেশের সবচেয়ে পুরানো ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে চট্টগ্রাম। এখান থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও পণ্য পাঠানো হতো। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পণ্য পরিবহনে ওজন স্কেল নির্ধারণ করে ১৩ টন। এতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের লোকসান গুনতে হচ্ছে। যেখানে সারাদেশের মোট পণ্যের ৯০ ভাগ চাহিদা মেটানো হতো চট্টগ্রাম থেকে, সেখানে এ প্রজ্ঞাপন জারির ফলে এ চাহিদা এখন অনেক কমে গেছে।
তিনি আরো বলেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে আরো মহাসড়ক রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের আইন অন্য কোনো মহাসড়কে নেই। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসীর সঙ্গে দ্বিমুখী ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। বাণিজ্যিক রাজধানীর মূল বিষয় হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল থাকা। কিন্তু মহাসড়কে ১৩ টনের ওজন স্কেলের কারণে আমাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান না হলে চট্টগ্রামকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর যে পরিকল্পনা রয়েছে তা বাস্তবায়ন হবে না।
এ বিষয়ে কথা হলো চট্টগ্রাম ট্র্যান্সপোর্ট ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি মো. নুরুল আবসারের সঙ্গে। তিনি জয়নিউজকে বলেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ ট্রাকের ওপর ১৩ টন ও কাভার্ড ভ্যানের ওপর ১২ টনের সীমা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আমরা ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীরা এ প্রজ্ঞাপনকে স্বাগত জানাই। কারণ এতে রাস্তাগুলো যেমন ঠিক থাকবে তেমনি গাড়িগুলোও ঠিক থাকবে। তবে এটি শুধু চট্টগ্রামে হলে চলবে না। এ আইন সারাদেশের অন্যান্য মহাসড়কেও কার্যকর করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৩ টনের ওজন স্কেল বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই নগরভবনের সামনে মানববন্ধন করেছিলেন। ওই মানববন্ধনে সরকারের প্রতি ৭ দিনের আল্টিমেটামও দেওয়া হয়। এছাড়া পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার এই ইস্যুতে নানা কর্মসূচি পালন করেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু দাবি পূরণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।