শেষটা হতে পারতো হাইকোর্টের রায়ে। অথবা নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিলের মাধ্যমে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে একের পর এক শীর্ষ নীতি-নির্ধারকের দণ্ড হতে পারতো আরেকটি কারণ। এর সঙ্গে যোগ হলো আইনি লড়াই ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে দলের প্রধান মুখপাত্র ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের বিদায় বলে দেওয়া। যাবার আগে দলকে বিলুপ্তির পরামর্শই দিয়ে গেছেন তিনি। সবমিলিয়ে সাম্প্রতিক অতীত বিশ্লেষণে জামায়াতে ইসলামীর শেষের শুরুটা দেখার চেষ্টা করেছেন জয়নিউজের সিনিয়র সহ-সম্পাদক মুহাম্মদ জুলফিকার হোসেন।
পুরানো প্রশ্নটাই আবার সামনে নিয়ে এসেছেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। জামায়াত কি তবে বিলুপ্তির পথে? নাকি পুরানো মানুষদের নিয়ে নতুন দল গঠন করে অস্তিত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করবে দলটি? প্রশ্ন আসলে অনেক।
দলের ভেতরে-বাইরে চলছে সমালোচনা। জোটে অবস্থান নড়বড়ে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন শক্ত অবস্থানে। জনসমর্থন কমতে শুরু করেছে অনেক আগ থেকেই। তাই দলের বর্তমান প্রজন্মের নেতারা খুব করেই চাইছিলেন জামায়াতের ইসলামীকে বিলুপ্ত করে নতুন নামে নতুন একটি দল গঠন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো হোক।
সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় নতুন দল গঠনের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা বেশ খোলাখুলিই বলেছেন দলটির এ প্রজন্মের নেতারা। সর্বশেষ দলটির অন্যতম নীতি-নির্ধারক ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকও দল ছাড়বার আগে জামায়াতকে বিলুপ্ত করে নতুন নামে দল গঠন করে দলীয় কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়ে গেছেন।
জামায়াতকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান রাজ্জাকের
শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) যুক্তরাজ্য থেকে দলের আমীর মকবুল আহমদের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। পদত্যাগের পেছনে তিনি দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, জামায়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি। একইসঙ্গে একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতার আলোকে ও অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে দলটি নিজেদের সংস্কার করতে পারেনি। একইদিন সন্ধ্যায় বিবিসি বাংলাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে নতুন নামে জামায়াতকে নতুন করে শুরু করার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
জামায়াত ‘ব্যথিত’
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের দলের সহকারী সেক্রেটারির পদ থেকে পদত্যাগ করাকে ব্যক্তিগত অধিকার বলে মনে করছে জামায়াতে ইসলামী। এক বিবৃতিতে আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগে ‘আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত’ উল্লেখ করে দলের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “পদত্যাগ করা যে কোনো সদস্যের স্বীকৃত অধিকার। আমরা দোয়া করি তিনি যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমরা আশা করি, তার সঙ্গে আমাদের মহব্বতের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।”
জামায়াত নিষিদ্ধে অনড় সরকার
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগের পর জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের অনড় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য অনেক আগেই জাতির কাছে জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল।” অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “জামায়াতের একজন ব্যক্তি স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, তার কোনো পজিশন রয়েছে কিনা জানি না। ব্যক্তির এ বক্তব্য- এটা ইম্পর্টেন্ট বিষয় নয়, যুদ্ধাপরাধীদের একজন আইনজীবী বলেই জানতাম। আমরা স্পষ্ট বলছি- জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ওদের ইন্ডিভিজুয়াল কোনো স্টেটমেন্টের গুরুত্ব নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- মামলা চলমান রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেলে নিষিদ্ধ হবে। তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই।”
বিএনপিতে দ্বিধাবিভক্তি, জোটে কোনঠাসা জামায়াত
বিএনপির একটি বড় অংশই এখন চায় দলটি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ুক। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “বিএনপি যখন জোটে জামায়াতকে রেখেছিল- আমি স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বার হিসেবে সবসময় বলে আসছি- না, তারা স্বাধীনতাবিরোধী দল; তাদের মুক্তিযুদ্ধে অনেক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড রয়েছে। তাদেরকে কখনও আমরা ধানের শীষ প্রতীক দিতে পারি না। তাদেরকে কখনও আমরা আমাদের ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে নিতে পারি না।” অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের অন্য দলগুলোও চাইছে জামায়াত যেন জোটে না থাকে। যে কারণে জোটেও বর্তমানে কোনঠাসা অবস্থায় আছে জামায়াত।
হাইকোর্টের রায় ও নির্বাচন কমিশনের অবস্থান
২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর জামায়াতের ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২–এর আওতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। দলটির নিবন্ধন নম্বর ছিল ১৪। ২০০৯ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা ৬৩০ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে আদালত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০এইচ ধারা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হলো।’